ফিতরা কি এর হুকুম


ফেতরা (فطرة) আরবী শব্দ, যা ইসলামে যাকাতুল ফিতর (ফিতরের যাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে খাদ্যদ্রব্য বোঝানো হয় যা দ্বারা রোজাদারগণ রোজা ভঙ্গ করেন।যাকাতুল ফিতর বলা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরীব দুঃস্থদের মাঝে রোজাদারদের বিতরণ করা দানকে। রোজা বা উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় ইফতার বা খাদ্য গ্রহন করা হয়। সেজন্য রমজান মাস শেষে ইদ দানকে যাকাতুল ফিতর বা আহারের যাকাত বলা হয়।

বিধানঃ

ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তা মুসলিমদের ওপর আবশ্যক করেছেন। সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘গোলাম, স্বাধীন, পুরুষ, নারী, ছোট, বড় সব মুসলিমের ওপর রাসূলুল্লাহ (সা.) এক ‘সা’ খেজুর, অথবা এক ‘সা’ গম জাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এবং নামাজের পূর্বে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।’ -সহিহ বোখারি ও মুসলিম

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যা আদেশ করেছেন তা আল্লাহতায়ালা কর্তৃক আদেশ করার সমতুল্য। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হুকুম মান্য করল, সে আল্লাহর হুকুমই মান্য করল। আর যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল, আমি আপনাকে তাদের জন্য পর্যবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি।’ -সূরা আন নিসা: ৮০

যাদের ওপর ফিতরা আবশ্যক

মাসয়ালা : প্রত্যেক স্বাধীন মুসলমানের ওপর ফিতরা আদায় কার ওয়াজিব। যার কাছে ঈদের দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য (ঘর, কাপড়, গাড়ি ইত্যাদি)-এর অতিরিক্ত সম্পদ থাকবে, তার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। এক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া শর্ত নয়। -আল জাওহারাতুন নিয়ারাহ: ১/১৭০

মাসয়ালা : সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য ওই পণ্য বছরকাল থাকা আবশ্যক নয়। ফিতরা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের পক্ষ থেকে পিতা আদায় করবেন। যে ব্যক্তি ওজরবশত বা গাফলত করে রোজা রাখেনি তাকেও সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে। --আল জাওহারাতুন নিয়ারাহ: ১/১৭০

মাসয়ালা : যে ব্যক্তি মালিকে নেসাব সে যদি ঈদের দিনে সুবহে সাদেকের সময়টুকু পায় তাহলে তার ওপর ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। এতে বুঝা যায়, যদি কোনো ব্যক্তি ঈদের দিন সুবহে সাদেকের পূর্বে মারা যায়, তাহলে তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। এভাবে যদি সুবহে সাদেকের পরে কোনো বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে তার পক্ষ থেকেও ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। তবে যদি কোনো ব্যক্তি সুবহে সাদেকের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করে বা কোনো বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে তাহলে তাদের ওপরও ফিতরা ওয়াজিব। -ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া: ২/৪১৭; ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি: ১/১৯২

ফিতরা আদায়ের সময়

সদকাতুল ফিতর আদায়ের সময় দু’ধরণের- ১. ফজিলতপূর্ণ সময় ও ২. সাধারণ সময়।

১. ফজিলতপূর্ণ সময়: 

ঈদের দিন সকালে ঈদের নামাজের পূর্বে। বোখারিতে বর্ণিত, আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমরা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে সদকাতুল ফিতর হিসেবে ঈদুল ফিতরের দিন এক সা’ পরিমাণ খাদ্য আদায় করতাম। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মানুষের ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করার আদেশ দিয়েছে।

সুতরাং ঈদুল ফিতরের নামাজ একটু বিলম্বে আদায় করা উত্তম। যাতে মানুষ সদকাতুল ফিতর আদায় করতে পারে।

২. জায়েজ সময়

ঈদের একদিন দু’দিন পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করা। তখন তা ওয়াজিব হিসেবেই আদায় হয়ে যাবে। তবে ঈদের দিন ঈদের নামাজের পূর্বেই আদায় করা মোস্তাহাব। যদি কোনো কারণবশতঃ ঈদের নামাজের পূর্বে আদায় করতে না পারে তাহলে পরে হলেও আদায় করা ওয়াজিব; এটা কখনো নফলে পরিণত হবে না। -হেদায়া: ১/২০৮

মাসয়ালা : ঈদের কতদিন পূর্বে ফিতরা আদায় করা যাবে? এ বিষয়ে ইসলামি স্কলারদের মতভেদ থাকলেও গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে, রমজানের পূর্বে আদায় করলেও ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। এমনকি কয়েক বছরের ফিতরা একত্রে আদায় করলেও তা আদায় হবে। -ফাতাওয়ায়ে শামি: ২/৩৬৭

সদকাতুল ফিতর প্রদানের স্থান 

মাসয়ালা : সদকাতুল ফিতর প্রদানের সময় যে এলাকায় সে অবস্থান করছে ওই এলাকার গরীবরাই বেশি হকদার। ওই এলাকায় সে স্থায়ী হোক বা অস্থায়ী। কিন্তু যদি তার বসতি এলাকায় কোনো হকদার না থাকে বা হকদার চেনা অসম্ভব হয়, তাহলে তার পক্ষে উকিল নিযুক্ত করবে। সে উপযুক্ত ব্যক্তি খুঁজে তার সদকাতুল ফিতর আদায় করে দিবে।

সদকাতুল ফিতরের হকদার

মাসয়ালা : সদকাতুল ফিতর হকদার হচ্ছে- 
১. দরিদ্র, ২. ঋণ আদায়ে অক্ষম, ৩. ঋণগ্রস্ত, তাকে প্রয়োজন পরিমাণ দেয়া যাবে। 

এক সদকাতুল ফিতর অনেক ফকিরকে দেয়া যাবে এবং অনেক সদকাতুল ফিতর এক মিসকিনকেও দেয়া যাবে। -দুররে মুখতার: ২/৩৬৭ 

সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ

মাসয়ালা : হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম সদকাতুল ফিতরের এক সা’ পরিমাণ আদায় করেছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা জাকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক ‘সা’ খানা, অথবা এক ‘সা’ গম, অথবা এক ‘সা’ খেজুর, অথবা এক ‘সা’ পনির, অথবা এক ‘সা’ কিশমিশ দ্বারা।’ 

অন্য হাদিসে আছে, আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী (সা.)-এর জামানায় আমরা সদকাতুল ফিতর দিতাম এক সা' খাদ্যবস্তু, তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল যব (বার্লি), কিশমিশ-মোনাক্কা, পনির ও খেজুর। -সহিহ বোখারি: ১/২০৪-২০৫

বর্ণিত এ দু’টি হাদিস থেকে বোঝা যায়, কোনো খাদ্যবস্তু দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে এবং এর পরিমাণ হলো এক সা'। যার বর্তমান বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এ বছর জনপ্রতি ৬০ টাকা।

মাসয়ালা : ইসলামি শরিয়া মতে আটা, খেজুর, কিসমিস, পনির ও যব ইত্যাদি পণ্যগুলোর যে কোনো একটির মাধ্যমে ফিতরা প্রদান করা যায়। আটার মাধ্যমে ফিতরা আদায় করলে জনপ্রতি এক কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্যে ৬০ টাকা আদায় করতে হবে। খেজুরের মাধ্যমে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্যে ১৬৫০ টাকা, কিসমিসের মাধ্যমে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্যে ১২০০ টাকা, পনির দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্যে ১৬০০ টাকা এবং যব দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ২০০ টাকা আদায় করতে হবে। 

Share this

Related Posts

Previous
Next Post »