যার উপর যাকাত ফরয

যার উপর যাকাত ফরয


প্রতিটি সম্পদশালী মুসলিম, বালেগ, সুস্থ মস্তিস্কসম্পন্ন নর-নারীর উপর যাকাত ফরয।
নিসাব : নিসাব পরিমান স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্যবসায়ী পন্যের উপর যাকাত ফরয। কোন জিনিসের নিসাব কি? তা উত্তমরূপে জেনে রাখা সকলের জন্য একান্ত প্রয়োজন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ নিুরূপঃ
শুধু স্বর্ণের নিসাব : সাড়ে সাত ভরি (তোলা)।
শুধু রৌপ্যের নিসাব : সাড়ে বায়ান্ন ভরি (তোলা)।
স্বর্ণ-রূপার একত্রে নিসাব : স্বর্ণ ও রূপা উভয় জিনিসই যদি কারও নিকট থাকে এবং এর কোনটাই নিসাব পরিমাণ নাও হয়; তবে উভয়টির মূল্য হিসাব করে দেখতে হবে। মূল্য যদি একত্রে রূপার নিসাব পরিমাণ হয়ে যায়, অর্থাৎ ৫২.৫ ভরি রূপার মূল্যের সমান হয়ে যায়, তবেই যাকাত আদায় করতে হবে।
নগদ টাকা পয়সার নিসাব : বাজার দর হিসাবে অন্তত ৫২.৫ ভরি রূপার মূল্যের পরিমাণ টাকা এক বছরকাল জমা থাকলে এর যাকাত আদায় করতে হবে।
ব্যবসায়ী পণ্যের নিসাব : কোন জিনিস বিক্রি করার উদ্দেশ্যে রাখা হলেই তাকে ব্যবসায়ী পণ্য মনে করা হবে। ৫২.৫ ভরি রূপার মূল্যের সমান মূল্যমান সম্পন্ন ব্যবসায়ী পণ্যের যাকাত দিতে হবে। বছরান্তে তখনকার বাজারদর হিসেবে মূল্য ধরতে হবে। খরিদ মূল্য ধরলে চলবে না।
যাকাত আদায় ফরয হওয়ার একটি মৌলিক শর্ত :স্বর্ণ, রূপা, টাকা-পয়সা বা ব্যবসায়ীর পণ্য নিসাব পরিমাণ হওয়ার পর তৎক্ষনাৎ যাকাত আদায় করা ফরয হয় না; বরং এক বছরকাল নিজের মালিকানাধীন থাকলেই যাকাত আদায় করা ফরয হয়। অতএব নিসাব পরিমাণ হওয়ার সাথে এক বছর অতিক্রান্ত হওয়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
একটি প্রণিধানযোগ্য কথা, বছরের শুরুতে যদি নিসাব পরিমান মাল বা টাকা-পয়সা থাকে আর বছরের মধ্যবর্তী সময় নিসাবের চেয়ে কমে যায়, আবার বছরের শেষাংশে নিসাবের পরিমাণ হয়ে যায় অথবা বছরের মধ্যবর্তী সময় আরো বৃদ্ধি পায় উভয় অবস্থাতেই বছরান্তে যে পরিমাণ মাল বা টাকা থাকবে তার যাকাত হিসবা করে আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, বছরের শেষে কি পরিমাণ থাতে তাই ধর্তব্য। মধ্য বছরের হ্রাস-বৃদ্ধি ধর্তব্য নয়।

যাকাতের পরিমাণ : 

সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত আদায় করতে হয়। যাকাত ফরয হওয়া মালের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে সঠিক মূল্য নির্ধারণ করে এর চল্লিশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ শতকরা আড়াই টাকা যাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে। সামান্য কম হলেও যাকাত আদায় হবে না।
বিশেষ কথা
১. অনেক লোককে দেখা যায়, নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ না থাকার কারণে যাকাত দেয়া সম্পর্কে সম্পুর্ন নিশ্চুপ আছে, কিন্তু তার কাছে সামান্য রূপা রয়েছে, যার ফলে স্বর্ণ ও রূপার সমষ্টিগত মূল্য রূপার নিসাবের পরিমান হয়ে যাকাত ফরয হয়ে রয়েছে- এদিকে খেয়ালই করছেন না। কাজেই বিষয়টির প্রতি সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। স্বর্ণ ও রূপা একত্রে রাখবেন না , যদি রাখেন তবে যাকাতের ব্যাপারে সজাগ থাকবেন।
২. স্বর্ণ-রৌপ্য, তা যে অবস্থাতেই থাকুক অর্থাৎ টুকরা আকারে অর্থবা অলংকার, বাসনপত্র, ঘড়ি, কলম, চশমার ফ্রেম, কাপড়ের আঁচলে জড়ানো আকারে এবং তা ব্যবহারে আসুক বা না- ই আসুক সর্বাবস্থায় যাকাত আদায় করতে হবে।
৩. অনেকে মনে করেন, নিত্য ব্যবহার্য অলংকারের যাকাত দিতে হবে না, কেবল তুলে রাখা অলংকারের যাকাত দিতে হবে। এ ধারণা সম্পুর্ণ ভুল। এরূপ যারা করেছেন তাদেরকে বিগত বছরগুলোর অনাদায়ী যাকাত হিসাব করে আদায় করতে হবে। অন্যথায় গোনাহগার হতে হবে।
ভাড়ায় প্রদত্ত জিনিস
ভাড়ায় খাটানো বাড়ি-ঘর বা অন্য কোন জিনিসের বেলায় বিধান হলো এই যে, মূল জিসিনটির যাকাত দিতে হবে না; বরং ভাড়ায় উপার্জিত টাকা যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তবে বছরান্তে যাকাত আদায় করতে হবে।

কর্জ প্রদত্ত টাকা

কাউকে টাকা কর্জ দিয়ে রাখলে সে টাকা ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত তার যাকাত দিতে হবে না। যখনই ফিরে পাওয়া যাবে, তখন বিগত বছরগুলোর যাকাত হিসবা করে আদায় করতে হবে, অন্যথায় নয়।
প্রভিডেন্ট ফান্ড
প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা যাখন হাতে আসবে, তখন থেকে বছরান্তে যাকাত দিতে হবে। হাতে আসার পূর্ববর্তী বছর সমূহের যাকাত আদায় করা জরুরী নয়।
বিগত বেতন
চাকরির বেতন, যা কয়েক বছর যাবৎ বাকি রয়ে গিয়েছিল, তা উসুল হওয়ার পূর্ববর্তী বছরসমূহের যাকাত আদায় করা ফরয হবে না।
বীমা কোম্পানীতে জমাকৃত টাকা
প্রিমিয়াম হিসেবে যে টাকা বীমা কোম্পানীতে জমা করা হয়েছে, প্রতি বছর হিসাব করে তার যাকাত দিতে হবে। ব্যাংকে জমাকৃত টাকারও অনুরূপ যাকাত দিতে হবে।
শরীকানা কারবার
শরীকানা কারবারে লাগানো টাকার যাকাত দিতে হবে। শরীকের অন্যান্য লোকজন যদি যাকাত নাও আদায় করে তবুও নিজের অংশের যাকাত হিসাব করে আদায় করতে হবে।
একটা পরামর্শ
প্রত্যেক সম্পদশালী লোকের কর্তব্য হলো চান্দ্রমাস হিসেবে কোন একটা মাসকে বছরের শুরু বলে ধার্য করে নেয়া এবং এই শুরু থেকে বার মাস অতিক্রান্ত হওয়ার হিসাব রেখে নিজের যাকাত দেয়ার উপযোগী মালের পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে  হিসাব করে যাকাত আদায় করা। এই কাজের সুবিধার জন্য প্রতি রমজান মাসকে বছর শুরু ধার্য করাই উত্তম। রমযান মাস থেকে পরবর্তী শাবান মাসে এক বছর পূর্ণ হবে। এতে যাকাত আদায় করার কাজটা পবিত্র মাহে রমযানে সমাধা করা যায়। ফলে ৭০ গুণ বেশী সওয়াব পাওয়ার সুযোগ হয়।

যেসব মালে যাকাত ফরয হয়



 

১. পশু ও জন্তু সম্পদের যাকাত: উষ্ট্রের সংখ্য ৫-৯ টি হলে =১টি ছাগী, আবার ১০-১৪ টি হলে =২টি ছাগী এবং ১৪-১৯টি পর্যন্ত =৩টি ছাগী। এভাবে পর্যায়ক্রমে গরু-মহিষ কমপক্ষে ৩০টি হলে ১ বছর বয়সী ১টি বাছুর যাকাত ফরয। তবে শর্ত মালিকানায় একবছর অতিবাহিত হওয়া। ছাগল ও ভেড়া কমপক্ষে ৪০টি হতে ১২০টিতে ১টি ছাগী, ১২১টি হতে ২০০টি পর্যন্ত ২টি ছাগী এভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ঘোড়া ও উট পালন করলে তার যাকাত আদায় করতে হবে।

 

২. স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত: সাড়ে সাত ভরি পরিমাণ স্বর্ণ বা এর তৈরি অলংকার, রৌপ্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি বা এর অলংকার অথবা স্বর্ণ-রৌপ্য উভয়ই থাকলে উভয়েরই মোট মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের সমান হলে, তার বাজার মূল্য ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।

 

৩. ব্যবসায় পণ্যের যাকাত: ব্যবসায়ের মজুদ পণ্যের মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের মূল্যের বেশী হলে তার উপর ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।

 

৪. কৃষি সম্পদের যাকাত: কৃষির উৎপন্ন ফসলের ক্ষেত্রে এ যাকাত আদায় করতে হবে তার নাম ওশর। এ ক্ষেত্রে নিসাব হলো, সেচবিহীন জমির ফসলের শতকরা ১০ ভাগ এবং সেচপ্রদানকৃত জমির ফসলের শতকরা ২০ অংশ। আবার নিসাব পরিমাণ ২৬ মন ১০ সের মতান্তরে ৩০ মন না হলে ওশর দিতে হবে না।

 

৫. মধুর যাকাত: ৫ অসাকের মূল্য হিসেবে মধুর নিসাব ধার্য হবে। অর্থাৎ ৬৫৩ কিলোগ্রাম হলে তাতে ওশর দিতে হবে।

 

৬. খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদের যাকাত: খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদে এক-পঞ্চমাংশ যাকাত দিতে হবে।

 

৭. নগদ টাকা ও মজুদ সম্পদের যাকাত: নগদ টাকা বা মজুদ ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের মূল্যামানের বেশী হলে তার ওপর শতকরা ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।

 

 

 

যে সব সম্পদের যাকাত দিতে হয় না



 

১. নিসাবের কম পরিমান সম্পদ,

 

২. নিসাব বছরের মধ্যেই অর্জিত ও ব্যয়িত সম্পদ

 

৩. ব্যবহার্য সামগ্রী

 

৪. শিক্ষা উপকরণ,

 

৫. ঘর-বাড়ী, দালান-কোঠা যা বসবাস কিংবা কলকারখানা হিসেবে ব্যবহৃত

 

৬. যন্ত্রপাতি ও সাজ সরঞ্জাম

 

৭. ব্যবহার্য যানবাহন

 

৮. ব্যবহার্য পশু,ঘোড়া যেহেতু জিহাদের কাজে ব্যবহার করা হয় আর তা যেহেতু বর্ধনশীল নয় তাই এর উপর কোন যাকাত নেই।আবার ক্রীতদাসের উপরও কোন যাকাত নেই।কারণ রাসূল(সাঃ) বলেছেন,ঘোড়া ও ক্রীতদাসের উপর কোন যাকাত নেই।

 

৯. ওয়াকফকৃত সম্পত্তি

 

১০. পোষা পাখি ও হাঁস মুরগী।

 

 

 

যাকাত বণ্টনের খাতসমূহ



 

যাকাত বণ্টনের ব্যাপারে আল-কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে:

 

﴿إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ﴾[التوبة:60]

 

অর্থাৎ সাদাকাহ (যাকাত) তো কেবল নি:স্ব, অভাবগ্রস্থ ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান।[তওবাঃ৬০]

 

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের আলোকে যাকাত ব্যয়ের খাত ৮টি। যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে পেশ করছি:

 

১. নিঃস্ব ফকীর (الفقير): ফকীহ বলা হয় যার কোন সম্পদ নেই, নেই তার উপযোগী হালাল উপার্জন, যদ্বারা তার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। যার খাওয়া-পরা ও থাকার স্থান নেই। অন্যান্য নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই। আবার কেউ বলেছেন, ফকীর সে যার সামান্য সম্পদ আছে। তবে জীবন ধারণের জন্য অপরের ওপর নির্ভর করে।

 

ফকীরের সংজ্ঞায় আল্লামা তাবারী বলেন, المحتاج المتعفف الذى لايسأل সে অভাবগ্রস্থ যে নিজেকে সর্বপ্রকার লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করে চলেছে, কারোর নিকটই কিছুর প্রার্থনা করে না।

 

ইবনে আববাস, হাসান আল বসরী, মুজাহিদ, ইকরামা ও জহুরীর মতে: ফকীর এমন ধরনের নিঃস্ব ব্যক্তিকে বলা হয়, যে মানুষের কাছে হাত পাতে না। তবে এক্ষেত্রে ফকীহদের সংজ্ঞা বিষয়ক ইমাম শাফিয়ীর দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নরূপ। তিনি বলেন, ফকীর ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে কর্মজীবি নয় , যার কোন সম্পদ নেই। ইমাম আবু হানিফা সহ অন্যান্য আহলুর রায়গণ বলেন-الفقير أحسن حالا من المسكين ومن الناس মিসকীন অপেক্ষা ফকীরের অবস্থা উত্তম।

 

মুলকথা হলো,

এ পর্যায়ের লোকদেরকে যাকাতের খাত থেকে সাহায্য করা যাবে।

 

এ খাতটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে আল্লাহ ৮টি খাতের মধ্যে সর্ব প্রথমে উল্লেখ করেছেন। আর আরবী বাচনিক রীতি আছে, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা সর্বপ্রথম বলা।

২. অভাবগ্রস্থ মিসকীন ( المسكين) : মিসকীন বলা হয় যার এমন পরিমাণ সম্পদ আছে যাদ্বারা তার ওপর নির্ভরশীল লোকদের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট নয়। মুহাম্মদ আলী সাবুনী বলেন, মিসকীন সেই যার কোন কিছুই নেই।[আবার কেউ কেউ বলেন, মিসকীন সে যার কিছু সম্পদ আছে কিন্তু লজ্জা সম্মানের ভয়ে কারো কাছে হাত পাতে না যারা। তারা জীবন-জীবিকার জন্য প্রানান্তকর প্রচেষ্টা করার পরও প্রয়োজন মত উপার্জন করতে পারেন না। এতকিছুর পরও নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারেন না। হাদীসে মিসকীনের পরিচয়ে বলা হয়েছে: «الذى لا يجد غنى يغنية ولا يفطن له فيصدق عليه ولا يقوم فيسأل الناس» যে ব্যক্তি তার প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ পায় না আর না তাকে বুঝতে বা চিনতে পারা যায়, যার জন্য লোকেরা তাকে আর্থিক সাহায্য করতে পারে। আর না সে লোকদের কাছে কিছু চায়।

 

আল-ফাতওয়া আল-হিন্দিয়ায় বর্ণিত আছে, মিসকীন এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যার কিছুই নেই, যে মানুষের কাছে হাত পাতে বেড়ায় এবং খোরাক-পোশাকের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়।

 

এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ (সা.) এর হাদীস উল্লেখযোগ্য, তিনি বলেন, সেই লোক মিসকীন নয়, যাকে একটি বা দুটি খেজুর অথবা দু-এক লোকমা খাবারের লোভ দ্বারে দ্বারে ঠেলে নিয়ে বেড়ায়। বরং মিসকীন সে যে কারো কাছে চায় না। এ সম্পর্কে জানতে হলে কুরআনের এ আয়াত পাঠ কর, তারা মানুষকে আগলে ধরে সাহায্য চায় না।

 

যেসব লোকদের প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ যাকাতের খাত থেকে দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে হযরত ওমর (রা) বলেন إذا أعطيتم فأغنوا যখন দিবেই, তখন ধনী বানিয়ে দাও সচ্ছল বানিয়ে দাও।

 

উপরে বর্ণিত দুটি খাতকে সর্বাগ্রে উল্লেখ করাতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা দারিদ্র দুর করা ও ফকীর মিসকীনদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানই যাকাত ব্যবস্থার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। আর যাকাতের আসল উদ্দেশ্যই তাই।

 

৩. যাকাত বিভাগের কর্মচারী (العامل): যারা যাকাত আদায়কারী, সংরক্ষণকারী, পাহারাদার, লেখক, হিসাব রক্ষক এবং তার বণ্টনকারী এদের সবাইকে যাকাতের ফান্ড থেকে বেতন দিতে হবে। তবে এমন যেন না হয় যে, আমিলদের পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে যাকাতের কোন অর্থ অবশিষ্ট না থাকে, সে ক্ষেত্রে তাদেরকে আদায়কৃত যাকাতের অর্ধেকের বেশী দেয়া যাবে না।[আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যবস্থা এজন্য করেছেন, যেন তারা মালের মালিকদের থেকে অন্য কিছু গ্রহণ না করেন। বরং এটা আসলে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের আওতায় পড়ে। রাষ্ট্রই এর যাবতীয় ব্যবস্থাপনা, গঠন ও পরিচালনা করবে। এসব লোককে নিয়োগও দিবে রাষ্ট্র।
এ ক্ষেত্রে কর্মচারীদের নিযুক্তির শর্তাবলী অন্যতম হচ্ছে:

 

ক) তাকে মুসলিম হতে হবে;

 

খ) পূর্ণ বয়স্ক ও সুস্থ্য বিবেকসম্পন্ন হতে হবে;

 

গ) যাকাতের বিধান সম্পর্কে ইলম থাকতে হবে;

 

ঘ) আমানতদারী ও কাজের যথেষ্ট যোগ্যতা থাকতে হবে;

 

ঙ) স্বাধীন মুসলিম নিয়োগ করতে হবে, ক্রীতদাস নয়।

 

 ৪. যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য (مؤ لفة القلوب) : ইসলামের জন্য যাদের মন আকর্ষণ করা প্রয়োজন কিংবা ইসলামের ওপর তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যে এমন লোকদের যাকাতের খাত থেকে প্রদান করা। মুয়াল্লাফাতুল কুলুব কারা তা নির্ণয়ে ফকীহ ও আলিমদের মতামত হচ্ছে:

 

ইমাম যুহরী বলেন: المؤلفة من أسلم من يهودى أو نصرانى وإن كان غنيا যে ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ইসলাম কবুল করবে, সে-ই এর মধ্যে গণ্য, সে যদি ধনী হয় তবুও।

 

ইমাম কুরতুবী বলেন, وهم قوم كانوا في صدر الإسلام ممن يظهر الإسلام يتألفون يدفع سهم من الصدقة اليهم لضعف يقينهم তাদেরকে মুয়াল্লাফাতুল কুলুব বলা হয়, যারা ইসলামী যুগে প্রকাশ্যভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছে, কিন্তু ইসলামের প্রতি তাদের বিশ্বাস দুর্বল হওয়ায় যাকাতের অর্থ দিয়ে তাদেরকে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত করা।

 

মুহাম্মদ আলী সাবুনী বলেন, هم قوم من أشرف العرب أعطاهم رسول الله صلى الله عليه وسلم ليتألف قلوبهم على الإسلام মুয়াল্লাফাতুল কুলুব হলেন, আরবদের উচ্চ মর্যাদাশীল ব্যক্তিত্বদের বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের দিকে তাদের হৃদয় জয় করার নিমিত্তে উপঢৌকন প্রদান করতেন।

 

এ শ্রেণীর লোকদের কয়েকটি পর্যায়ে আছে, যেমন:

 

ক) এমন লোক যাকে অর্থ-সম্পদ দিলে সে বা তার গোত্র বা বংশের লোকেরা ইসলাম কবুল করবে বলে আশা করা যায়। যেমন এ রকম অনেক ঘটনা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

 

খ) নতুন ইসলাম কবুলকারী লোকেরা, তাদেরকে যাকাতের খাত থেকে প্রদান। যে অন্য ধর্মের লোক সে যখন ইসলাম কবুল করবে, সেই এর মধ্যে গণ্য । সে যদি ধনী হয় তবুও তাকে এ ফান্ড থেকে দেয়া যাবে।

 

গ) দুর্বল ঈমানের লোকেরা, এমন লোক যাদেরকে অর্থ প্রদান করলে ঈমান দৃঢ় ও শক্তিশালী হবে এবং কাফিরদের সাথে জিহাদে তাদের থেকে বেশী আনুকুল্য পাওয়া যাবে। মহানবী (সা) এ শ্রেণীর লোকদেরকে যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমাতের মাল বেশী বেশী প্রদান করতেন। ফলে তারা ইসলামী আদর্শে আরো দৃঢ়তা ও অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছিলেন।ঘ) কাফির বা অন্য ধর্মের লোক। যাকে অর্থ উপহার দিলে তারা গোত্র বা বংশের লোকেরা ইসলাম কবুল করবে বলে আশা করা যায়।[এ প্রসঙ্গে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সাফওয়ান ইবন উমায়্যাহকে হুনাইন যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমাতের মাল থেকে প্রদান করেছিলেন। অথচ সে সময়ে তিনি মুশরিক ছিলেন। সাফওয়ান বলেন, মহানবী (সা.) এরূপভাবে আমার প্রতি তার দানের হাত সম্প্রসারিত করতে লাগলেন অবশেষে তিনি আমার কাছে সবচেয়ে ভাল মানুষ হিসেবে পরিগণিত হলেন। পরবর্তীতে তিনি মহানবী (সা.) এর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করেছিলেন বলে জানা যায়।

 

ঙ) শত্রু পক্ষের প্রতিবন্ধকতা ও শত্রুতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এমন শ্রেণীর লোক যার দুষ্কৃতির ভয় করা হয়, সীমান্তে অমুসলিম শত্রু দেশের আক্রমণ প্রতিরক্ষা ও মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে পারে এমন লোক, তাদেরকে যাকাতের ফান্ড থেকে অর্থ প্রদান করা।

 

৫. দাসমুক্তির জন্য (الرقاب) : যে ক্রীতদাস তার মালিককে অর্থ প্রদানের বিনিময়ে মুক্তিলাভের জন্য চুক্তিবন্ধ হয়েছে। এখানে এ পর্যায়ে মুসলিম যুদ্ধবন্ধীও এ খাতের আওতায় পড়বে। কাযী ইবনুল আরাবী বলেন, মুসলিম দাসকে যখন মুক্ত করতে যাকাতের খাত থেকে দেয়া যাবে, ঠিক তেমনি মুসলিম বন্দীকে কাফিরদের দাসত্ব শৃঙখলা ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা অধিক উত্তম বলে বিবেচিত হবে।এ বিষয়ে বিখ্যাত তাফসীরকারক সাইয়্যেদ রশীদ রিযা বলেন, فى الرقاب বলে যাকাতের যে ব্যয় খাতটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাকে পরাধীন গোত্র ও জাতিসমূহকে মুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা যাবে।

 

 

 

৬. ঋণভারাক্রান্তদের জন্য (الغارمون) : এমন ব্যক্তি যে ঋণভারাক্রান্ত অবস্থায় নিপতিত, তাকে যাকাতের ফান্ড থেকে সাহায্য করা। তবে যে কোন অসৎ কাজে বা অপব্যয়ের কারণে ঋণভারাক্রান্ত হয়েছে তাওবা না করা পর্যন্ত যাকাতের ফান্ড দেয়া যাবে না। আবার ঋণভারাক্রান্ত এর পর্যায়ে যেমন জীবিত ব্যক্তি শামিল, তেমনি মৃত্যু ব্যক্তিও এর আওতায় পড়ে। মৃতব্যক্তি যিনি ঋণ রেখে মারা গিয়েছেন। ইমাম কুরতুবী (রা.) তাই বলেছেন।

 

ইবনুল হুমাম বলেছেন, গারিমুন হচ্ছে সে সমস্ত লোক যাদের উপর ঋণের বোঝা চেপে আছে অথবা লোকদের নিকট পাওনা আছে কিন্তু তারা তা আদায় করছে না, তাকে গারিমুন বলার প্রচলন আছে।

 

৭. আল্লাহর পথে: আল্লাহর পথ বলতে আকীদা বিশ্বাস ও কাজের দিক দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয় যে পথ, তাই আল্লামা রশীদ আহমদ বলেছেন, فى سبيل الله ইসলামী শাসন পুন:প্রতিষ্ঠার চেষ্টা প্রচেষ্টার কাজই ফী সাবিলিল্লাহর খাত। অর্থাৎ ইসলামী জীবন বিধান পুন:প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালানো, যেখানে ইসলামী আইন বিধান বাস্তবায়িত হবে, মুসলিম সভ্যতার পুনরাভ্যুদয়, মুসিলম উম্মতের পুনজার্গরণ, ইসলামী আকীদা বিশ্বাস, আচার-আচরণ, শরীয়াত, চরিত্র ইত্যাদি সবকিছু পুরামাত্রায় কার্যকর হবে।

 

ইবনুল আসীর বলেন, فى سبيل الله এর অর্থ এমন কার্যক্রমকে বুঝায় যা খালিস নিয়্যাত আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে, তা ফরয নফল ও বিভিন্ন ধরনের ইবাদত বন্দেগীকে বুঝায়।

 

জালালুদ্দিন সুয়ুতী বলেন, فى سبيل الله এর অর্থ যারা জিহাদের কাছে নিয়োজিত আছে।

 

সলফে সালেহীনদের মতে ফী সাবিলিল্লাহ আল্লাহর দ্বীনের প্রচার, প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী দেশষমূহের প্রতিরক্ষার জন্য পরিচালিত প্রচেষ্টা সাধনা ও সামগ্রিক তৎপরতাকে বুঝায়। এখানে فى سبيل الله অর্থ স্বশস্ত্র সংগ্রামকে বুঝানো হয়েছে।

 

ইসলাম বিরোধী শক্তি তাদের চেষ্টা সাধনা ও অর্থ শক্তি দ্বারা লোকদেরকে আল্লাহর পথে চলার বাধাদানে নিয়োজিত হলে বিত্তশালী মুসলিমদের কর্তব্য হবে তাদের শক্তি, সামর্থ ও অর্থ দ্বারা কুফরী শক্তি প্রতিরোধকারীদের সাহায্য করা। তাই এরূপ সাহায্য করাই ফরয যাকাতের একটি অংশ নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

 

মূলত আল্লাহর পথের পর্যায় ও স্তর অনেক। যেসব কাজের নির্দেশনা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তা সবই এর আওতায় পড়বে। ওলামায়ে কিরামদের বিশ্লেষণে জিহাদের কয়েকটি পর্যায়ের অন্যতম হচ্ছে:

 

এক. দাওয়াত ইলাল্লাহ, আল্লাহর পথে আপামর মানুষকে দাওয়াত দেয়া। যুগে যুগে সকল নবী রাসূলগণ তাদের সমসাময়িক জনগণকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়েছেন। তারা বলেছেন,
 يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُ 
অর্থ হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতিত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই।[আনফালঃ৫৯]

 

 দুই. নিজেকে সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে পেশ করা। আল্লাহ বলেন: ‘‘কথায় কে উত্তম ঐ ব্যক্তির চেয়ে যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে আমি তো অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত।

 

তিন. জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ: আল্লাহর বাণী
وَجَٰهِدُواْ فِي ٱللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ
আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ কর আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ করা উচিত।[হাজ্জঃ৭৮]

 

৮. মুসাফিরদের জন্য: এমন যার নিজ আবাসস্থলে সম্পদ আছে, কিন্তু সফরে সে বিপদগ্রস্থ ও নি:স্ব তাকে যাকাতের তহবিল থেকে সাহায্য করা। তবে সে সফর পাপের কাজের বা অনুরূপ পর্যায়ের কোন সফর হওয়া যাবে না।

 

আল্লামা তাবারী মুজাহিদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, যাকাতের সম্পদ ধনী হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের নি:স্ব পথিকের একটি হক রয়েছে। যদি সে তার নিজের ধন-সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

 

মুসাফিরদেরকে খোরাক-পোশাকের ব্যয় এবং লক্ষ্যস্থল পর্যন্ত পৌঁছার জন্য যা প্রয়োজন অথবা তার ধন-মাল পথিমধ্যে কোথাও থাকলে তা যেখানে রয়েছে, সে পর্যন্ত পৌঁছার খরচ যাকাতের ফান্ড থেকে দিতে হবে।

 

কতুটুকু পরিমাণ দিতে হবে এ ব্যাপারে দুটি মত পাওয়া যায়। এক: যাতায়াত ও অবস্থানের প্রয়োজনীয় খরচ ছাড়া অতিরিক্ত দেয়া যাবে না। দুই. প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণ করা তার বৈধ হবে।

 

 

 

 আর্থ-সামাজিক উন্নযনে যাকাতের ভূমিকা


 

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম। ড. হাম্মুদাহ আবদালাতি এ প্রসঙ্গে বলেন, জরুরী পরিস্থিতিতে যাকাতের রেটের কোন সীমারেখা নেই। যে যত বেশী দান করবে সবার জন্য ততই মঙ্গলজনক। বিভিন্ন তহবিল গঠনে যে প্রচারণা চালানো হয় যাকাত তাদের সব লক্ষ্যই পুরণ করে।

 

১. দুশ্চিন্তামুক্ত সমাজ গঠন: এ কথা আজ অবিসংবাদিত সত্য যে, যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতি সম্পূর্ণরুপে দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারে। একটি সুখী, সুন্দর ও উন্নত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিত্তশালী মুসলিমদের অবশ্যই তাদের সম্পদের একটি অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদের দুর্দশা মোচনের জন্য ব্যয় করতে হবে। এর ফলে যে শুধু অসহায় এবং দুস্থ মানবতারই কল্যাণ হবে তা নয়, সমাজে আয় বন্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য অনেকখানি হ্রাস পাবে। [1] কোন ব্যক্তির কাছে অর্থ-সম্পদ নেই; যাকাত তাকে অর্থের যোগান দেবে, মৃত্যুর পরে তার পরিবার পরিজন ও সন্তানদের লালন-পালন করবে, বেকার, অক্ষম, বিকলাঙ্গ, রুগ্ন ও বিধবাদের সম্মানজনক জীবন যাপনের নিশ্চয়তা দেবে।সে সমাজে চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, আত্মসাৎ, জবরদখল, সুদ-ঘুষসহ সব অনৈতিক কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

 

২. যাকাত ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণে আর্থ-সামাজিক সেতুবন্ধন: প্রকৃতপক্ষে যাকাত ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দুর করে ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ইসলামী নৈতিকতা ও অর্থনৈতিক বিধান মেনে চললে সমাজে কখনও ধনী দরিদ্রের আকাশ চুম্বি পার্থক্য সৃষ্টি হতে পারে না। বর্তমানে শ্রেণী বিভক্ত, বৈষম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার কারণে এক শ্রেণীর লোক সব সময় অবহেলিত। একমাত্র যাকাত ব্যবস্থাই পারে শ্রেণীহিন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। প্রকৃতপক্ষে যাকাত, সাদকা দান উপঢৌকন, আপ্যায়ন, খাদ্য বিতরন, সালাম বিনিময় এ সকলের মাধ্যমে সম্প্রীতি, ঐক্যবোধ পারস্পারিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা এবং কল্যাণ কামনার বুনিয়াদের সকল বৈষম্য দুর হয়ে সাম্য মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বভিত্তিক কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই ইসলামে সামাজিক বৈষম্য দুর করে সাম্য মৈত্রীর সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাকাত বিধান এক বিষ্ময়কার ব্যবস্থার নাম।

 

৩. যাকাত ব্যবস্থায় ধনীদের সম্পদে দরিদ্রের অধিকার: যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনীদের সম্পদে গরীবদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহ দারিদ্রমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের ব্যবস্থা করেছেন। যাকাত দুস্থ দারিদ্রের প্রতি ধনীদের দয়া বা অনুকম্পা নয় বরং অধিকার
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,
وَفِيٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ حَقّٞ لِّلسَّآئِلِ وَٱلۡمَحۡرُومِ
এবং তাদের সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্থ ও বঞ্চিতদের হক। [যারিয়াতঃ১৯]

 

অন্যত্র বলা হয়েছে ধনীদের যা প্রদান করতে বলা হয়েছে তা বদান্যতা নয়, বরং গরীবদের অধিকার حق অধিকার হিসেবেই তা গরীবদের নিকট ফেরত আসা উচিত। বস্ত্তত গরীবরাই তাদের শ্রম দ্বারা জাতীয় সম্পদ সৃষ্টি করে।[3]

 

৪. অভাব, দুর্দশা, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সমাজ গঠনে যাকাত: যাকাতের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার দারিদ্র বিমোচন, যা সামাজিক নিরাপত্তার মূল চালিকা শক্তি। যাকাত বন্টনের ৮টি খাতের মধ্যে ৪টি খাতই (ফকির, মিসকিন, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্থ) সর্বহারা, অসহায়, অভাবগ্রস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য নিবেদিত। এছাড়া নও মুসলিমের খাতটাও বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে এর মধ্যে আসতে পারে। মহানবী (সা.) বলেছেন, তোমরা দরিদ্র লোকের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করো। তাদের প্রতি সাধ্যমত অনুগ্রহ ও উপকার করো। আখিরাতের পথে তারা তোমাদের জন্য সংগৃহীত ধন এবং প্রধান সম্বল। কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাববুল আলামিন দরিদ্রের প্রতি আদেশ করবেন যে, পৃথিবীতে যারা তোমাদের এক লোকমা অন্ন এবং এক ঢোক পানি দান করেছে, এক প্রস্থ বস্ত্র দান করেছে আজ তোমরা তাদের হাত ধরে জান্নাতে চলে যাও।ওমর (রা) বলেছেন, আমার রাজ্যে ফোরাত নদীর তীরে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মারা যায় তাহলে তার জন্য আমি উমরকে আল্লাহর কাছে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িযে জবাবদিহি করতে হবে।

 

৫. যাকাত সম্পদ পবিত্র করে সামাজিক সম্প্রীতি স্থাপন করে: 

 

মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ পালন ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে যাকাত দেয় তা তার নিজের জন্য পবিত্রকারী।[1] এ কাজটিকে যাকাত বলার কারণ হলো এভাবে যাকাতদাতার অর্থসম্পদ এবং তার নিজের আত্মা পবিত্র ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। যে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া অর্থ সম্পদ থেকে আল্লাহর বান্দাদের অধিকার বের করে দেয় না, তার অন্তরে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা নেই। সে সাথে তার আত্মা থেকে যায় অপবিত্র। কেননা আল্লাহ যে তার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এ জন্য তার অন্তরে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা নেই। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনের আসছে

 

 ﴿ خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم ﴾

 

‘তাদের সম্পদ হতে যাকাত (সাদাকা) গ্রহণ করবে, যা দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে।
MONDAY, 26 AUGUST 2013
প্রশ্নঃ যাকাতের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ কি?যাকাতের অর্থ বৃদ্বিকারী ও পবিত্রকারী বলা হয় কেন? যাকাত কখন ফরয হয়? যাকাতের খাত সমূহ কি কি? ঘোড়া বা ক্রীতদাসের উপর যাকা ফরয হয় কিনা? দারিদ্র্যাতা বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা কি?

যাকাত এর আভিধানিক পরিচয়


 

যাকাত একটি ব্যাপক প্রত্যয়। এটি আরবী শব্দ زكوة থেকে গেৃহীত। যার অর্থ পবিত্রতা বা পরিশুদ্ধতা। যাকাতের আরেক অর্থ পরিবর্ধন (Growth)শুধু তাই নয়, যাকাত একাধারে পবিত্রতা, বর্ধিত হওয়া, আর্শীবাদ (Blessing) এবং প্রশংসা অর্থেও ব্যবহৃত হয়, কুরআন ও হাদিসে যাকাতের এ সব তাৎপর্য নিহিত।আল্লামা জুরযানী বলেন- الزكاة فى اللغة الزيادة[অর্থাৎ যাকাতের আভিধানিক অর্থ অতিরিক্ত। মাওলানা আব্দুর রহীম বলেন, যাকাত শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে প্রবৃদ্ধি (Growth), প্রবৃদ্ধি লাভ (Increa8uuuse), প্রবৃদ্ধির কারণ (To Cause to grow) ইত্যাদি যা আল্লাহ প্রদত্ত বারাকাত (Blessing) থেকে অর্জিত হয়।

 

ইসলাম বিশ্বকোষে যাকাতের অর্থ সম্পর্কে আছে, যাকাত অর্থ পবিত্রতা ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা।

 

কারণ আল্লাহ বলেন,

 

তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহকর যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে।[তওবাঃ১০৩]

 

আল্লামা শাওকানী বলেন,

 

যাকাত শব্দটি মূল زكاء এর অর্থ প্রবৃদ্ধি, বর্ধিত হওয়া। কোন জিনিস বৃদ্ধি পেলে এই শব্দ বলা হয় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া। খুব বেশী কল্যাণকময় হলে তা زكى বলা হয়। আর ধন সম্পদের একটা অংশ বের করে দিলে তাকে যাকাত বা প্রবৃদ্ধি পাওয়া বলা হয়, অথচ তাকে কমে। তা বলা হয় এ জন্য যে যাকাত দিলে তাকে বরকত বেড়ে যায় বা যাকাত দাতা অধিক সওয়াবের অধিকারী হয়।

 

ইবনুল মানযুর বলেন, যাকাত শব্দের অর্থ হলো পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি ও আধিক্য।

 

সাদী আবু জীব বলেন, যাকাত আদায়ের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে সম্পদ কমলেও প্রকারান্তে এর পরিবর্ধন ঘটে। এছাড়া এর মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয় এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে সমাজ হয় মুক্ত ও পবিত্র।

 

আবুল হাসান বলেন, যাকাতের অর্থ الطهارة والنماء والبركة والمدح পবিত্রতা, বৃদ্ধি, বরকত ও প্রশংসা।

 

আল মুজামুল অসীতে আছে, আভিধানিক অর্থ زكا যে জিনিস ক্রমশ বৃদ্ধি পায় ও পরিমাণে বেশী হয়। زكا فلان অমুক ব্যক্তি যাকাত দিয়েছে অর্থ-সুস্থ ও সুসংবদ্ধ হয়েছে।

 

অতএব, যাকাত হচ্ছে বরকত, পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়া, প্রবৃদ্ধি লাভ, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা, শুদ্ধতা- সুসংবদ্ধতা।

 

 

 

যাকাত এর পারিভাষিক পরিচয়


 

ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় জীবন যাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন পুরণের পর সম্পদে পূর্ণ এক বছরকাল অতিক্রম করলে ঐ সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলা হয়।

 

 ইউসুফ কারযাভী বলেন, শরীয়াতের দৃষ্টিতে যাকাত ব্যবহৃত হয় ধন-মালে সুনির্দিষ্ট ও ফরযকৃত অংশ বোঝানোর জন্য। যেমন পাওয়ার যোগ্য অধিকারী লোকদের নির্দিষ্ট অংশের ধন-মাল দেওয়াকে যাকাত বলা হয়।

 

ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, যাকাত আল্লাহ নির্দেশিত অংশ ধন-মাল থেকে হকদারদের দিয়ে দেয়া, যাতে মন-আত্মা পবিত্র হয় এবং ধন-মাল পরিচ্ছন্ন হয় ও বৃদ্ধি পায়।

 

নিজের অর্থ সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ অভাবী মিসকিনদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়াকে যাকাত বলে। এটাকে যাকাত বলার কারণ হল এভাবে যাকাত দাতার অর্থ সম্পদ এবং তার নিজের আত্মা পবিত্র -পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। যাকাতের শরয়ী অর্থই তো, আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে কোন মালদার ব্যক্তি কর্তৃক কোন হকদার ব্যক্তিকে তার মালের নির্ধারিত অংশ অর্পন করা।

 

 

 

যাদের উপর যাকাত ফরয ঃ


 

প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন সকল ‘সাহেবে নিসাব’ মুসলিম নর-নারীর উপর যাকাত প্রদান করা ফরয। কোন ব্যক্তি মৌলিক প্রয়োজনীয় উপকরণাদি ব্যতীত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পর চাঁদের হিসেবে পরিপূর্ণ এক বৎসর অতিবাহিত হলে তার উপর পূর্ববর্তী বৎসরের যাকাত প্রদান করা ফরয। অবশ্য যদি কোন ব্যক্তি যাকাতের নিসাবের মালিক হওয়ার পাশাপাশি ঋণগ্রস্থ হয়, তবে ঋণ বাদ দিয়ে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে, তার উপর যাকাত ফরয হবে। যাকাত ফরয হওয়ার পর যদি কোন ব্যক্তি যাকাত প্রদান না করে টাকা খরচ করে ফেলে, তাহলেও তাকে তার পূর্বের যাকাত দিতে হবে। নাবালেগ ও পাগলের উপর যাকাত ফরয হবে না। কারণ, তাদের উপর শরীয়তের বিধান আরোপিত হয়না। তবে যদি কোন মস্তিষ্ক বিকৃত ব্যক্তি নিসাবের মালিক হওয়ার সময় এবং বৎসর পরিপূর্ণ হওয়ার সময় সুস্থ থাকে, কিন্তু মধ্যবর্তী সময় মস্তিষ্ক বিকৃতির শিকার হয় তাহলেও তাকে যাকাত প্রদান করতে হবে।

 

 

 

যেসব মালে যাকাত ফরয হয়


 

১. পশু ও জন্তু সম্পদের যাকাত: উষ্ট্রের সংখ্য ৫-৯ টি হলে =১টি ছাগী, আবার ১০-১৪ টি হলে =২টি ছাগী এবং ১৪-১৯টি পর্যন্ত =৩টি ছাগী। এভাবে পর্যায়ক্রমে গরু-মহিষ কমপক্ষে ৩০টি হলে ১ বছর বয়সী ১টি বাছুর যাকাত ফরয। তবে শর্ত
রমজান মাসে তারাবির নামাজ জামাতে পড়ার বিধান

রমজান মাসে তারাবির নামাজ জামাতে পড়ার বিধান

পবিত্র
রমজান মাসের রাতে ইশার ফরজ ও সুন্নত নামাজের পর বিতরের আগে ২০ রাকাত নামাজ পড়া সুন্নতে মুআক্কাদাহ। পুরো রমজান মাসে তারাবির নামাজ জামাতে পড়া ও সম্পূর্ণ কোরআন একবার খতম করাও সুন্নতে মুআক্কাদাহ।

তারাবিহ নামাজ : পবিত্র রমজান মাসের রাতে ইশার ফরজ ও সুন্নত নামাজের পর বিতরের আগে ২০ রাকাত নামাজ পড়া সুন্নতে মুআক্কাদাহ। পুরো রমজান মাসে তারাবির নামাজ জামাতে পড়া ও সম্পূর্ণ কোরআন একবার খতম করাও সুন্নতে মুআক্কাদাহ। খতমে তারাবিতে হাফেজ সাহেবের জন্য কোনো প্রকার টাকা-পয়সার শর্তারোপ করা জায়েজ নেই। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমানসহকারে শুধু সওয়াবের আশায় তারাবি পড়েন, তার অতীতের সব (ছগিরা) গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়’ [বুখারি ও মুসলিম শরিফ]।
শাওয়ালের ছয় রোজার ফযীলত

শাওয়ালের ছয় রোজার ফযীলত

রোজা
ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ এবং সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। রোজা  সিয়ামের সর্বপ্রথম শিক্ষা ভোগস্পৃহা নিয়ন্ত্রণ করে দেহমনকে ত্যাগের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে তোলা। সুবহে সাদিকের পূর্বমুহূর্ত থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও সম্ভোগ থেকে পরিপূর্ণরূপে বিরত থাকার নাম সিয়াম সাধনা। এই সঙ্গে শরীর ও মনকেও আল্লাহতায়ালার নাফরমানি থেকে সচেতনভাবে দূরে রাখাও সিয়ামে পরিপূর্ণতা লাভ করার শর্ত।
সিয়াম ফরজ হয়েছে হিজরতের প্রায় দুবছর পর, যখন মুসলমানরা মক্কার বৈরী পরিবেশ থেকে সরে এসে শঙ্কামুক্ত ও অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল জীবন লাভ করেছিলেন। তাদের ওপর তখন নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পিত হচ্ছিল। সমগ্র মানবজাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তখন তাদের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়েছে। এ গুরুভার পালন করার জন্য যে নৈতিক বল এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন, তা অর্জন করার পন্থারূপে আল্লাহপাক তাকওয়ার গুণ অর্জন বিধিবদ্ধ করেছেন। আর সে তাকওয়া অর্জনের প্রকৃষ্ট মাধ্যমরূপে চিহ্নিত করেছেন রমজানের রোজাকে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মুমিনরা! তোমাদের জন্য সিয়াম বিধিবদ্ধ করা হলো, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (আল-বাকারা-১৮৩)
নির্ভরযোগ্য তাফসির গ্রন্থগুলোয় তাকওয়া শব্দের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, সহজ কথায় তা হচ্ছে এমন একটা চারিত্রিক শক্তি, যার মাধ্যমে নিজেকে সর্বক্ষণ মহাপরাক্রান্ত সৃষ্টিকর্তার সামনে উপস্থিত থাকার অনুভূতি জাগ্রত থাকে। আর এ অনুভূতির আলোকেই সব ধরনের অনাচার থেকে আত্মরক্ষা সম্ভব হয়।
সিয়াম ফরজ করা সম্পর্কিত আয়াতটি এমনভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, যা দ্বারা বোঝা যায়, এটি কোনো শাস্তি কিংবা চাপিয়ে দেওয়া কঠিন কোনো পরীক্ষা নয়। বরং একটি বৃহত্তর কল্যাণ লাভ করার একটা সোপান মাত্র। ফলে আগের জামানার অনুগ্রহপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর মতোই আমাদের জন্যও এটি একটি বিশেষ অনুগ্রহের দান ছাড়া আর কিছু নয়।
রমজান এমন একটা মাসের নাম, যে মাসে আল্লাহতায়ালা মানবজাতির জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অনুগ্রহরাজি বর্ষণ করেছেন। এ মাসেই কোরআন নাজিল হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘রমজানই সেই তাৎপর্যপূর্ণ মাস, যে মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে মানবজাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য।’ (আল-বাকারা)
এ মাসের মধ্যেই এমন একটি রাত লুকিয়ে রাখা হয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এখানে হাজার মাস বলতে এমন এক অনন্তকাল বোঝানো হয়েছে, যা গণনা করা সম্ভব নয়। এ রাতের সন্ধান লাভ এবং পূর্ণ আদবের সঙ্গে তা উদ্যাপন করার ফজিলতও এত ব্যাপক, যা বর্ণনা করার ভাষা কারও জানা নেই।
চার ধরনের পাপে লিপ্ত ব্যক্তি ছাড়া বাকি সবাইকে আল্লাহপাক এ রাতে ক্ষমা করে দেন। যারা শরাব পানে অভ্যস্ত, যারা মাতা-পিতার অবাধ্য, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে রয়েছে এবং যাদের অন্তরে অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ক্রিয়াশীল।
হাদিস শরিফে রমজান মাসকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এর প্রথম দশ দিন রহমতের, দ্বিতীয় দশ দিন ক্ষমার এবং তৃতীয় দশ দিন দোজখের আগুন থেকে মুক্তির।
ধর্মীয় চিন্তাবিদদের ব্যাখ্যামতে, রোজাদাররা সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে। প্রথমত, যারা পাপ থেকে মুক্ত এবং অধীর আগ্রহে রমজানের জন্য অপেক্ষমাণ থাকে। রমজান এদের জন্য অফুরন্ত রহমতের বার্তা নিয়ে উপনীত হয়।
দ্বিতীয়ত, যারা পাপে লিপ্ত, তবে রমজানের আগমন উপলক্ষে তওবা করতে থাকেন এবং পাপ থেকে দূরে সরার জন্য আল্লাহর কাছে তাওফিক কামনা করতে থাকেন। রমজানের প্রথম দশ দিন রোজা রাখার পর দ্বিতীয় দশ দিন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য ক্ষমার ঘোষণা শোনানো হয়।
তৃতীয়ত, ওইসব লোক, যাদের পাপের বোঝা অত্যন্ত ভারী। কিন্তু রমজান আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা তওবা করেন এবং ভক্তিভরে রোজা রাখতে শুরু করেন। শেষ দশ দিনে উপনীত হওয়ার পর এসব লোকের জন্যও জাহান্নাম থেকে মুক্তি নসিব হয়ে যায়।
সহিহ হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, রমজানুল মোবারককে আল্লাহপাক নিজের মাসরূপে আখ্যায়িত করেছেন। ব্যাখ্যাকারকদের ভাষায়, এ মাসে আল্লাহতায়ালার রহমত ও বরকত বৃষ্টিধারার মতো বর্ষিত হতে থাকে। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তই এমন মূল্যবান, যার বিকল্প চিন্তাও করা যায় না।
সাহাবি হজরত আবু হোরাইরা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, ‘আল্লাহর রসুল (সা.) বলেন, অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো সংগত কারণ ছাড়া যদি কেউ রমজান মাসের একটা রোজাও ভঙ্গ করে, তবে অবশিষ্ট সমগ্র জীবন রোজা রেখেও তার ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হবে না।’ (তিরমিযি, আবু দাউদ)
কারণ রমজান মাসে রহমতের যে প্লাবনধারা প্রবাহিত হয়, বছরের অন্য কোনো সময় তা কল্পনাও করা যায় না।
রোজাদার ব্যক্তির অনুভূতিতে সর্বক্ষণ আল্লাহর সজাগ অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে। দারুণ তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েও সে নির্জন গৃহকোণে এক ফোঁটা পানিও গলাধঃকরণ করে না। অন্য কোনো ইবাদতের মধ্যে এমন সার্বক্ষণিক ও সতর্ক আত্মনিবেদন লক্ষ করা যায় না।
অন্যদিকে রোজা এমন একটা ইবাদত, যা রোজাদার ব্যক্তি নিজে প্রকাশ না করা পর্যন্ত অন্য কারো পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। এজন্যই বোধহয় আল্লাহর তরফ থেকে বলা হয়েছে, রমজান আমার মাস এবং এর প্রতিদান আমি নিজের হাতেই দিব (বোখারি)।
রমজান আমল করার মাস। এর প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহপাকের বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করার এক মহা মৌসুম। হজরত সালমান ফারেসি (রা.) বর্ণিত একখানা হাদিসে বলা হয়েছে, রমজান মাসে প্রতিটি নফল ইবাদতের সওয়াব ফরজ আদায়ের সমান হয়ে যায়। আর প্রতিটি ফরজ ইবাদতের সওয়াব সত্তর গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় (মেশকাত শরিফ)।
আবু হোরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলে মকবুল (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে এবং সওয়াবের একিনসহ রমজানের রোজা রাখে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি রমজানের রাত জাগরণ করে ইবাদতে লিপ্ত থাকে তারও পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি শবেকদরে ইমান ও একিনের সঙ্গে ইবাদত করে তারও সব গুনাহ আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করে দেন (বোখারি ও মুসলিম)। 
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে রমজানের প্রকৃত শিক্ষা ও তাকওয়া অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
রমজান মাসে সালাতুত তারাবিহ পড়ার বিধান কী?

রমজান মাসে সালাতুত তারাবিহ পড়ার বিধান কী?


যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব হাসিলের আশায় রমাদানে কিয়ামু রমজান (সালাতুত তারাবিহ) আদায় করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’ [বুখারি : ২০০৯]সালাতুত তারাবিহ পড়া এ মাসের অন্যতম আমল। তারাবিহ পড়ার সময় তার হক আদায় করতে হবে। হাদিসে এসেছে,« مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ»‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব হাসিলের আশায় রমাদানে কিয়ামু রমজান (সালাতুত তারাবিহ) আদায় করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’ [বুখারি : ২০০৯]তারাবিহ এর সালাত বিতরসহ ২৩ রাকাআত, ২১ রাকাআত, ১৩ রাকাআত, অথবা ১১ রাকাআত পড়া যাবে। তারাবিহ এর সালাত তার হক আদায় করে অর্থাৎ ধীরস্থীরভাবে আদায় করতে হবে। তারাবিহ জামায়াতের সাথে আদায় করা সুন্নাহ এর অন্তর্ভুক্ত।হাদিসে আছে,«إِنَّهُ مَنْ قَامَ مَعَ الإِمَامِ حَتَّى يَنْصَرِفَ كُتِبَ لَهُ قِيَامُ لَيْلَة»ٍ‘‘যে ব্যক্তি ইমামের সাথে প্রস্থান করা অবধি সালাত আদায় করবে (সালাতুত তারাবিহ) তাকে পুরো রাত কিয়ামুল লাইলের সাওয়াব দান করা হবে’’ [সুনান আবূ দাউদ : ১৩৭৭, সহিহ]।



ফিতরা কি এর হুকুম

ফিতরা কি এর হুকুম


ফেতরা (فطرة) আরবী শব্দ, যা ইসলামে যাকাতুল ফিতর (ফিতরের যাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে খাদ্যদ্রব্য বোঝানো হয় যা দ্বারা রোজাদারগণ রোজা ভঙ্গ করেন।যাকাতুল ফিতর বলা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরীব দুঃস্থদের মাঝে রোজাদারদের বিতরণ করা দানকে। রোজা বা উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় ইফতার বা খাদ্য গ্রহন করা হয়। সেজন্য রমজান মাস শেষে ইদ দানকে যাকাতুল ফিতর বা আহারের যাকাত বলা হয়।

বিধানঃ

ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তা মুসলিমদের ওপর আবশ্যক করেছেন। সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘গোলাম, স্বাধীন, পুরুষ, নারী, ছোট, বড় সব মুসলিমের ওপর রাসূলুল্লাহ (সা.) এক ‘সা’ খেজুর, অথবা এক ‘সা’ গম জাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এবং নামাজের পূর্বে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।’ -সহিহ বোখারি ও মুসলিম

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যা আদেশ করেছেন তা আল্লাহতায়ালা কর্তৃক আদেশ করার সমতুল্য। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হুকুম মান্য করল, সে আল্লাহর হুকুমই মান্য করল। আর যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল, আমি আপনাকে তাদের জন্য পর্যবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি।’ -সূরা আন নিসা: ৮০

যাদের ওপর ফিতরা আবশ্যক

মাসয়ালা : প্রত্যেক স্বাধীন মুসলমানের ওপর ফিতরা আদায় কার ওয়াজিব। যার কাছে ঈদের দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য (ঘর, কাপড়, গাড়ি ইত্যাদি)-এর অতিরিক্ত সম্পদ থাকবে, তার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। এক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া শর্ত নয়। -আল জাওহারাতুন নিয়ারাহ: ১/১৭০

মাসয়ালা : সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য ওই পণ্য বছরকাল থাকা আবশ্যক নয়। ফিতরা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের পক্ষ থেকে পিতা আদায় করবেন। যে ব্যক্তি ওজরবশত বা গাফলত করে রোজা রাখেনি তাকেও সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে। --আল জাওহারাতুন নিয়ারাহ: ১/১৭০

মাসয়ালা : যে ব্যক্তি মালিকে নেসাব সে যদি ঈদের দিনে সুবহে সাদেকের সময়টুকু পায় তাহলে তার ওপর ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। এতে বুঝা যায়, যদি কোনো ব্যক্তি ঈদের দিন সুবহে সাদেকের পূর্বে মারা যায়, তাহলে তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। এভাবে যদি সুবহে সাদেকের পরে কোনো বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে তার পক্ষ থেকেও ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। তবে যদি কোনো ব্যক্তি সুবহে সাদেকের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করে বা কোনো বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে তাহলে তাদের ওপরও ফিতরা ওয়াজিব। -ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া: ২/৪১৭; ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি: ১/১৯২

ফিতরা আদায়ের সময়

সদকাতুল ফিতর আদায়ের সময় দু’ধরণের- ১. ফজিলতপূর্ণ সময় ও ২. সাধারণ সময়।

১. ফজিলতপূর্ণ সময়: 

ঈদের দিন সকালে ঈদের নামাজের পূর্বে। বোখারিতে বর্ণিত, আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমরা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে সদকাতুল ফিতর হিসেবে ঈদুল ফিতরের দিন এক সা’ পরিমাণ খাদ্য আদায় করতাম। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মানুষের ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করার আদেশ দিয়েছে।

সুতরাং ঈদুল ফিতরের নামাজ একটু বিলম্বে আদায় করা উত্তম। যাতে মানুষ সদকাতুল ফিতর আদায় করতে পারে।

২. জায়েজ সময়

ঈদের একদিন দু’দিন পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করা। তখন তা ওয়াজিব হিসেবেই আদায় হয়ে যাবে। তবে ঈদের দিন ঈদের নামাজের পূর্বেই আদায় করা মোস্তাহাব। যদি কোনো কারণবশতঃ ঈদের নামাজের পূর্বে আদায় করতে না পারে তাহলে পরে হলেও আদায় করা ওয়াজিব; এটা কখনো নফলে পরিণত হবে না। -হেদায়া: ১/২০৮

মাসয়ালা : ঈদের কতদিন পূর্বে ফিতরা আদায় করা যাবে? এ বিষয়ে ইসলামি স্কলারদের মতভেদ থাকলেও গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে, রমজানের পূর্বে আদায় করলেও ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। এমনকি কয়েক বছরের ফিতরা একত্রে আদায় করলেও তা আদায় হবে। -ফাতাওয়ায়ে শামি: ২/৩৬৭

সদকাতুল ফিতর প্রদানের স্থান 

মাসয়ালা : সদকাতুল ফিতর প্রদানের সময় যে এলাকায় সে অবস্থান করছে ওই এলাকার গরীবরাই বেশি হকদার। ওই এলাকায় সে স্থায়ী হোক বা অস্থায়ী। কিন্তু যদি তার বসতি এলাকায় কোনো হকদার না থাকে বা হকদার চেনা অসম্ভব হয়, তাহলে তার পক্ষে উকিল নিযুক্ত করবে। সে উপযুক্ত ব্যক্তি খুঁজে তার সদকাতুল ফিতর আদায় করে দিবে।

সদকাতুল ফিতরের হকদার

মাসয়ালা : সদকাতুল ফিতর হকদার হচ্ছে- 
১. দরিদ্র, ২. ঋণ আদায়ে অক্ষম, ৩. ঋণগ্রস্ত, তাকে প্রয়োজন পরিমাণ দেয়া যাবে। 

এক সদকাতুল ফিতর অনেক ফকিরকে দেয়া যাবে এবং অনেক সদকাতুল ফিতর এক মিসকিনকেও দেয়া যাবে। -দুররে মুখতার: ২/৩৬৭ 

সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ

মাসয়ালা : হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম সদকাতুল ফিতরের এক সা’ পরিমাণ আদায় করেছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা জাকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক ‘সা’ খানা, অথবা এক ‘সা’ গম, অথবা এক ‘সা’ খেজুর, অথবা এক ‘সা’ পনির, অথবা এক ‘সা’ কিশমিশ দ্বারা।’ 

অন্য হাদিসে আছে, আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী (সা.)-এর জামানায় আমরা সদকাতুল ফিতর দিতাম এক সা' খাদ্যবস্তু, তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল যব (বার্লি), কিশমিশ-মোনাক্কা, পনির ও খেজুর। -সহিহ বোখারি: ১/২০৪-২০৫

বর্ণিত এ দু’টি হাদিস থেকে বোঝা যায়, কোনো খাদ্যবস্তু দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে এবং এর পরিমাণ হলো এক সা'। যার বর্তমান বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এ বছর জনপ্রতি ৬০ টাকা।

মাসয়ালা : ইসলামি শরিয়া মতে আটা, খেজুর, কিসমিস, পনির ও যব ইত্যাদি পণ্যগুলোর যে কোনো একটির মাধ্যমে ফিতরা প্রদান করা যায়। আটার মাধ্যমে ফিতরা আদায় করলে জনপ্রতি এক কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্যে ৬০ টাকা আদায় করতে হবে। খেজুরের মাধ্যমে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্যে ১৬৫০ টাকা, কিসমিসের মাধ্যমে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্যে ১২০০ টাকা, পনির দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্যে ১৬০০ টাকা এবং যব দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ২০০ টাকা আদায় করতে হবে। 
পবিত্র কোরআন খতমের বিনিময়ে হাদিয়া নেওয়া যাবেকী?

পবিত্র কোরআন খতমের বিনিময়ে হাদিয়া নেওয়া যাবেকী?

তম
তারাবীর ইমামতি করে বিনিময় বা
হাদিয়া নেওয়া জায়েয় কি না? এক
মাসের জন্য নিয়োগ দিয়ে বেতন
দিলে জায়েয হবে কি না? কেউ কেউ
বলেন, ফরয নামাযের ইমামতির
বিনিময় গ্রহণ যখন জায়েয তাই
খতম তারাবীর বিনিময় গ্রহণও
জায়েয হবে। এছাড়া হাফেয
সাহেবকে যদি দু’ এক ওয়াক্ত ফরয
নামাযের দায়িত্ব দেওয়া হয় তবে
তো নাজায়েয হওয়ার প্রশ্নই থাকে
না। তাদের একথা ঠিক কি না?
ইমামতির হীলা হোক বা অন্য
কোনো উপায়ে তারাবীর বিনিময় বৈধ
হবে কি না? দলিল-প্রমাণসহ
বিস্তারিত জানতে চাই।
উত্তর:
খতম তারাবীর বিনিময় দেওয়া-নেওয়া
দুটোই নাজায়েয। হাদিয়ার নামে
দিলেও তা জায়েয হবে না। এক
মাসের জন্য নিয়োগ দিয়ে বেতন
হিসেবে দিলেও জায়েয নয়। কারণ
এক্ষেত্রেও প্রদেয় বেতন তারাবীহ
এবং খতমের বিনিময় হওয়া স্বীকৃত।
মোটকথা, খতম তারাবীর বিনিময়
গ্রহণের জন্য কোনো হীলা
অবলম্বন করলেও তা জায়েয হবে
না। কারণ খতম তারাবী খালেস একটি
ইবাদত, যা নামায-রোযার মতো
ইবাদতে মাকসূদার অন্তর্ভুক্ত। আর
এ ধরনের ইবাদতের বিনিময় বা বেতন
দেওয়া-নেওয়া উম্মতে মুসলিমার
ঐক্যমতের ভিত্তিতে নাজায়েয।
এতে না কোনো মাযহাবের
মতপার্থক্য আছে, না পূর্ববর্তী ও
পরবর্তী ফকীহগণের মাঝে কোনো
মতভেদ আছে।
ইমামতির বেতন ঠিক করা এবং তা
আদায় করা যদিও পরবর্তী
ফকীহগণের দৃষ্টিতে জায়েয। কিন্তু
খতম তারাবীর বিনিময়টা ইমামতির
জন্য হয় না। বরং তা মূলত কুরআন
খতমের বিনিময়ে হয়ে থাকে। আর
তেলাওয়াতের বিনিময় গ্রহণ করা
সকল ফকীহের নিকট হারাম।
অধিকন্তু পরবর্তী ফকীহগণ যে
ইমামতির বেতন জায়েয বলেছেন
সেটা হল ফরয নামাযের ইমামতি।
সুন্নত নামাযের ইমামতি এর
অন্তর্ভুক্ত নয়।
আর হাফেযদের দেওয়া বিনিময়কে
জায়েয করার জন্য এই হীলা
অবলম্বন করা যে, শুধু রমযান মাসের
জন্য তার উপর দু এক ওয়াক্ত
নামাযের ইমামতির দায়িত্ব দেওয়া
হবে-এটা একটা বাহানামাত্র। যা
পরিহার করা জরুরি। কারণ এই হীলার
অর্থ হল যে, এ বিনিময়টা তাকে
ফরয নামাযের ইমামতির জন্য
দেওয়া হচ্ছে। আর খতম তারাবী সে
বিনিময়হীনভাবেই করে দিচ্ছে। কিন্তু
নিজের মনকে একটু প্রশ্ন করে
দেখুন, যদি ওই হাফেয সাহেব তার
দায়িত্বে অর্পিত ফরয নামাযের
ইমামতি যথাযথ গুরুত্বের সাথেই
আদায় করেন, কিন্তু খতম তারাবীর
ইমামতি না করেন তবে কি তাকে ওই
বিনিময় দেওয়া হত? এ কথা সুস্পষ্ট
যে, কখনো তা দেওয়া হত না। বোঝা
গেল, বিনিময়টা মূলত খতম তারাবীর,
ফরযের ইমামতির নয়।
এজন্যই আকাবিরদের অনেকে এই
হীলা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর
দলিলের ভিত্তিতেও তাঁদের
ফতওয়াই সহীহ। দেখুন : ইমদাদুল
ফাতাওয়া ১/৩২২; ইমদাদুল আহকাম
১/৬৬৪
এ বিষয়ে কিছু হাদীস আছারের
অনুবাদ ও ফিকহের কিতাবের উদ্ধৃতি
পেশ করা হল।
১. আবদুর রহমান ইবনে শিবল রা.
থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
তোমরা কুরআন পড়। তবে তাতে
বাড়াবাড়ি করো না। এর প্রতি বিরূপ
হয়ো না। কুরআনের বিনিময় ভক্ষণ
করো না এবং এর দ্বারা সম্পদ
কামনা করো না।-মুসনাদে আহমদ
৩/৪২৮, হাদীস : ১৫৫২৯; মুসান্নাফ
ইবনে আবী শাইবা ৫/২৪০
২. ইমরান ইবনে হুসাইন রা. থেকে
বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে,
তোমরা কুরআন পড় এবং আল্লাহ
তাআলার কাছে প্রার্থনা কর।
তোমাদের পরে এমন জাতি আসবে,
যারা কুরআন পড়ে মানুষের কাছে
প্রার্থনা করবে।-মুসনাদে আহমদ
৪/৪৩৭, হাদীস : ১৯৯১৭
৩. আবদুল্লাহ ইবনে মা’কিল রা.
থেকে বর্ণিত, তিনি এক রমযানে
লোকদের নিয়ে তারাবীহ পড়লেন।
এরপর ঈদের দিন উবাইদুল্লাহ ইবনে
যিয়াদ রাহ. তার কাছে এক জোড়া
কাপড় এবং পাঁচশ দিরহাম পাঠালেন।
তখন তিনি কাপড় জোড়া এবং
দিরহামগুলো এই বলে ফেরত দিলেন
যে, আমরা কুরআনের বিনিময় গ্রহণ
করি না।
-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৫/২৩৭,
হাদীস : ৭৮২১ আরো দেখুন :
ফাতাওয়া শামী ৬/৫৭; তানকীহুল
ফাতাওয়াল হামীদিয়া ২/১৩৭-১৩৮;
আলইখতিয়ার লিতালীল মুখতার
২/৬২; শিফাউল আলীল ওয়া বাল্লুল
গালীল (মাজমুআ রাসায়েল ইবনে
আবেদীন) ১/১৫৪-১৫৫; ইমদাদুল
ফাতাওয়া ১/৩১৫-৩১৯; রাফেউল
ইশকালাত আনহুমাতিল ইস্তিজার
আলাত্তাআত, মুফতীয়ে আযম
হযরত মাওলানা মুফতী ফয়যুল্লাহ
রাহ.
মহিলাদের তারাবির নামাজ জামাতের সাথে পড়ার বিধান আছে কি, থাকলে তা কি ভাবে আদায় করতে হবে?

মহিলাদের তারাবির নামাজ জামাতের সাথে পড়ার বিধান আছে কি, থাকলে তা কি ভাবে আদায় করতে হবে?

মহিলাদের তারাবির নামাজ জামাতের সাথে পড়ার বিধান আছে কি, থাকলে তা কি ভাবে আদায় করতে হবে?

ওমর (রা.) এর সময়ে মহিলাদের মসজিদে
যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়
মুফতি মাওলানা ওসমান গণী সালেহী
মুহাদ্দিস, দারুন্নাজাত সিদ্দিকীয়া,
ঢাকা
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সিদ্ধান্ত
মতে, 'মহিলাদের তারাবি নামাজ
জামাতে আদায় করার উদ্দেশ্যে
মহিলাদের মসজিদে যাওয়া মাকরুহে
তাহরিমি।' এ ব্যাপারে হজরত সাহাবাই
কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন,
আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীনসহ সবাই ইজমা
বা একমত হয়েছেন। অপরদিকে মহিলাদের
ঘরে নামাজ আদায় মুস্তাহাব এবং ২৫ গুণ
বেশি ফজিলতের কারণ। (আবু দাউদ, আহমদ,
দায়লামি, তাবারানি, সহিহ ইবনে
হিব্বান, মুয়াত্তা মালিক)। রাসূলে পাক
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
জমানায় তারাবি নামাজ জামাতে পড়া
হতো না, তারাবি নামাজে কোরআন
শরিফ খতম হতো না। অনুরূপভাবে যদিও
প্রথম যুগে ইসলাম ও মুসলমানদের বৃহত্তর
স্বার্থে মহিলাদের জামাতে উপস্থিত
হওয়ার অনুমতি ছিল কিন্তু হজরত ওমর (রা.)
এর খেলাফতকালে তা নিষিদ্ধ ঘোষণা
করা হয় এবং পরে ইমাম, মুজতাহিদ
মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামাতে
নামাজ পড়া মাকরুহে তাহরিমি ফতুয়া
প্রদান করেন এবং এর ওপর উম্মতের ইজমা
প্রতিষ্ঠিত হয়।
মসজিদে না গিয়ে নিজ ঘরে আদায়ই
কাম্য
মাওলানা ইকবাল হোছাইন মাসুম<br>
ইমাম-খতিব মসজিদ ইমাম আবু হানিফা
(রহ.) খাঁপাড়া, টঙ্গী, গাজীপুর।
মহিলাদের জন্য অন্যান্য সালাতের ন্যায়
তারাবির সালাতও মসজিদে না গিয়ে
নিজ ঘরে আদায়ই কাম্য। কেননা রাসূল
(সা.) বলেছেন, মহিলাদের জন্য ঘরে
সালাত মসজিদে সালাতের চেয়ে উত্তম।
অনেকে নারীদের মসজিদে গিয়ে
জামাতে শরিক হওয়ার দলিল হিসেবে ওই
হাদিসটি পেশ করেন, তোমরা আল্লাহর
বান্দিদের মসজিদে যেতে বাধা দিও না,
অথচ তারা অন্য কথাগুলো সামনে রাখেন
না। আর মহিলাদের যেসব শর্তে মসজিদে
আসার অনুমতি তখন দেয়া হয়েছিল, এখন
সে শর্তগুলো পূরণ করা হয় না। ব্যক্তিগত
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মহিলারা পর্দা
ঠিক মতো করে না, অনেক যুবতী বোন
সাজসজ্জা করে মসজিদে আসেন। এসব
কারণেই তাদের মসজিদে আসার অনুমতি
দেয়ার পরবর্তী সময়ে না আসতেই
উৎসাহিত করা হয়েছে। খোদ হারাম
শরিফের দরসে বলা হয়েছে, এখানে
নামাজ পড়লে ১ লাখ গুণ সওয়াব বেশি হবে,
যা হাদিসে বলা হয়েছে। কিন্তু মহিলারা
যদি এখানে নামাজ না পড়ে ঘরে পড়েন
তবে তাদের জন্য সেখানেই এর চেয়ে
বেশি সওয়াব লেখা হবে।
পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে মসজিদে
যাওয়ার অনুমতি থাকা উচিত
সিরাজুম মুনিরা প্রভাষক,<br> ইসলাম
শিক্ষা বিভাগ পটুয়াখালী সরকারি
কলেজ।
আমি মনে করি, মেয়েদের মসজিদে গিয়ে
তারাবি নামাজ পড়ার অনুমতি থাকা
উচিত। কারণ, এটা মেয়েদের অধিকারের
পর্যায়ে পড়ে। তবে তার আগে সেরকম
পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মসজিদে
তাদের জন্য আলাদা রুম দিয়ে সেখানে
পর্দার ব্যবস্থা করতে হবে। এমনকি
মসজিদে আলাদা যাতায়াতের ব্যবস্থাও
করতে হবে। অন্যথায় নয়। অনেকেরই
মসজিদের একদম কাছেই বাসা। হয়তো
পাশের বিল্ডিংয়ে, যাতায়াতে পর্দার
খেলাপ হওয়ার সুযোগ নেই। তাদের জন্য
এমন নিষেধাজ্ঞা তাদের বঞ্চিত করার
সমতুল্য। সাধারণত সারা বছর আমরা
মসজিদে যাওয়ার সুযোগ পাই না। এই একটি
মাস আমাদের জন্য সুযোগ হিসেবে আসে।
এখানে ঐক্যের একটি ব্যাপার আছে। এই
একটি মাধ্যমে আমরা অন্য মুসলিম বোনদের
সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি। পরস্পর ধর্মীয়
বিভিন্ন মাসলা-মাসায়েল নিয়ে
আলোচনা করতে পারি। তবে সব কিছুর
আগে পর্দার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত
করতে হবে।
কিয়ামতের ছোট-বড় আলামতগুলো প্রকাশিত হতে শুরু হলে তখন কি হবে?

কিয়ামতের ছোট-বড় আলামতগুলো প্রকাশিত হতে শুরু হলে তখন কি হবে?

একজন মুসলিমের উপর যে সমস্ত বিষয়ের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব, তার মধ্যে আখেরাত তথা শেষ দিবসের প্রতি এবং সেখানকার নেয়ামত ও আযাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুকন। মানুষ পার্থিব জগত এবং তার ভোগ-বিলাসের মাঝে ডুবে থেকে কিয়ামত, পরকাল এবং তথাকার শাস্তি ও নেয়ামতের কথা ভুলে যেতে পারে। ফলে আখেরাতের মঙ্গলের জন্য আমল করাও ছেড়ে দিতে পারে। এ জন্য মহান আল্লাহ কিয়ামতের পূর্বে এমন কতগুলো আলামত নির্ধারণ করেছেন, যা আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার অকাট্য প্রমাণ বহন করে এবং সকল প্রকার সন্দেহ দূর করে দেয়।প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের পূর্বাভাস স্বরূপ যে সমস্ত আলামতের কথা বলেছেন, একজন মুমিন ব্যক্তি যখন ঐ সমস্ত আলামতসমূহের কোন একটি আলামত দেখতে পাবে তখন তার ঈমান বৃদ্ধি পাবে, নিশ্চিতভাবে কিয়ামতের আগমণে বিশ্বাস স্থাপন করবে, ঈমান শক্তিশালী হবে, মন থেকে সমস্ত সন্দেহ দূর হবে, কিয়ামতের জন্যে প্রস্ত্ততি নিবে এবং সময় শেষ হওয়ার আগেই সৎকাজে আত্মনিয়োগ করবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের যে সমস্ত আলামতের বর্ণনা দিয়েছেন তার অনেক আলামত হুবহু প্রকাশিত হয়েছে। এ সমস্ত আলামত দেখে মুমিনদের ঈমান প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নবুওয়াতের প্রমাণগুলো দেখে ইসলামের প্রতি তাদের আনুগত্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেন তা হবেনা? আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার পূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সমস্ত গায়েবী বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন, তা আজ হুবহু বাস্তবায়িত হতে দেখছে। আফসোস ঐ ব্যক্তির জন্য! দিবালোকের মত সুস্পষ্ট নিদর্শনগুলো দেখেও যে কিয়ামত দিবসকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল অথবা তার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করল।
কিয়ামত একটি বিরাট গায়েবী ঘটনা। তা অস্বীকারকারী কিংবা তাতে সন্দেহ পেষাণকারীর সন্দেহ দূর করার জন্য এসব আলামত বর্ণনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আলামতগুলো দেখে কিয়ামতে বিশ্বাস করা তার জন্যে সহজ হয়ে যাবে। সন্দেহকারী যখন তার চোখের সামনে আলামতগুলো দেখতে পাবে তখন তার কাছে এ বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে যে, যিনি কিয়ামত হবে বলে সংবাদ দিয়েছেন, তিনিই তো কিয়ামতের আলামত আসার কথা বলেছেন। কুরআন ও হাদীছের বর্ণনা মোতাবেক আলামতগুলো যখন এসে যাবে তখন এ বিষয়ের সংবাদদাতাকে মিথ্যুক বলার কোন সুযোগ অবশিষ্ট থাকবেনা। কারণ সংবাদের বিষয়বস্ত্ত বাস্তবে পরিণত হয়েছে। সংবাদদাতার অধিকাংশ সংবাদ সত্যে পরিণত হওয়ার অর্থ এই যে, তার বাকী সংবাদগুলোও সত্য হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের পূর্বে যে সমস্ত আলামত আসবে বলে ঘোষণা করেছেন বড় আলামতগুলো ব্যতীত অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। যেগুলো এখনও বাস্তবায়িত হয়নি অদূর ভবিষ্যতে তা অবশ্যই বাস্তবে পরিণত হবে এবং সকল আলামত প্রকাশ হওয়ার পর নির্ধারিত সময়ে মহাপ্রলয় তথা রোজ কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে।
হাদীছের বর্ণনা মোতাবেক ভবিষ্যৎ বাণীগুলো সত্যে পরিণত হলে ঈমান দৃঢ়, মজবুত ও শক্তিশালী হবে। এই তো মুসলমানেরা প্রতি যুগেই বিভিন্ন ঘটনা হুবহু বাস্তবায়িত হতে দেখে আসছে। কুরআন ভবিষ্যৎ বাণী করেছিল যে, অচিরেই রোমানরা পারস্যবাসীদের উপর বিজয় লাভ করবে। অতঃপর পুনরায় তারা পরাজিত হবে। সাহাবীগণ পারস্যবাসীদের উপর রোমানদের বিজয় প্রত্যক্ষ্য করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ওফাতের পর মুসলমানগণ রোম ও পারস্য জয় করেছেন। সকল দ্বীনের উপর ইসলামের বিজয় অবলোকন করেছেন। এমনিভাবে আরো অনেক ঘটনা সত্যে পরিণত হচ্ছে এবং মুমিনদের ঈমান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া আগামীতে যে সমস্ত ফিতনার আগমণ ঘটবে তাতে একজন মুসলমান কিভাবে চলবে, কিভাবে তা থেকে পরিত্রাণ পাবে, অনাগত পরিস্থিতিতে শরীয়তের বিধান কি হবে, তা জানার জন্যে এবং সে অনুযায়ী আমল করার জন্যে কিয়ামতের আলামতগুলো সম্পর্কে প্রতিটি মুসলিমের জ্ঞান থাকা জরুরী।
কিয়ামতের অন্যতম বড় আলামত হচ্ছে দাজ্জালের আগমণ। সে পৃথিবীতে চল্লিশ দিন অবস্থান করবে। প্রথম দিনটি হবে এক বছরের মত লম্বা। দ্বিতীয় দিনটি হবে একমাসের মত। তৃতীয় দিনটি হবে এক সপ্তাহের মত। আর বাকী দিনগুলো দুনিয়ার স্বাভাবিক দিনের মতই হবে। সাহাবীগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেনঃ যে দিনটি এক বছরের মত দীর্ঘ হবে সে দিন কি এক দিনের নামাযই যথেষ্ট হবে? উত্তরে তিনি বললেনঃ ‘‘না; বরং তোমরা অনুমান করে সময় নির্ধারণ করে নামায পড়বে’’।[মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।] এমনিভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘আখেরী যামানায় কিয়ামতের পূর্বে মুসলিমগণ পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হবে’’। তিনি এ সমস্ত যুদ্ধে শরীক হতে নিষেধ করেছেন এবং ফিতনা থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। মোটকথা, ইসলামের অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় কিয়ামতের আলামতগুলো সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা রাখা প্রতিটি মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব। এই বইটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করলে তা সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব হবে।
রোজা রেখে ধুমপান করলে কী হবে?

রোজা রেখে ধুমপান করলে কী হবে?

সামান্য পরিমাণ ধূমপান করলেও রোজা ভেঙে যায়। আর স্বেচ্ছায় ধূমপান করার কারণে কাজা-কাফফারা উভয়টি আদায় করা আবশ্যক হয়। অতএব, আপনি রোজা অবস্থায় যে কয়দিন ধূমপান করবেন

প্রশ্ন : আমি ধূমপানে অভ্যস্ত। রমজান মাসে রোজা রাখা অবস্থায়ও যখন ধূমপান না করার কারণে অস্থিরতা অনুভূত হয়, তখন একটু ধূমপান করি। এতে কি আমার রোজা ভেঙে যাবে?
উত্তর : হ্যাঁ, সামান্য পরিমাণ ধূমপান করলেও রোজা ভেঙে যায়। আর স্বেচ্ছায় ধূমপান করার কারণে কাজা-কাফফারা উভয়টি আদায় করা আবশ্যক হয়। অতএব, আপনি রোজা অবস্থায় যে কয়দিন ধূমপান করবেন, প্রতিটি রোজার ভিন্ন ভিন্ন কাজা আদায় করবেন এবং সবগুলোর জন্য একটি কাফফারাও আদায় করবেন।
[আদ্দুররুল মুখতার ২/৩৯৫; হাশিয়াতুত তহতাবী আলাদ্দুর ১/৪৫০; ইমদাদুল ফাত্তাহ ৬৮১]
পবিত্র রমজান মাসে করনীয় ও বর্জনীয়

পবিত্র রমজান মাসে করনীয় ও বর্জনীয়



شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ.
রমজান মাস যে মাসে অবতীর্ণ হয়েছে আল-কুরআন, যা মানবজাতির জন্য হেদায়াত এবং হেদায়াতের সুষ্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী বিধান। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে এই মাসটি পাবে, সে রোজা রাখবে। আর যে অসুস্থ অথবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গননা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না, যাতে তোমরা গননা পূরণ করো এবং তোমাদের হেদায়াত দান করার দরুন আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো। [সূরা বাকারাহ : ১৮৫]
ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম ফরজ ইবাদত হলো সিয়াম বা রোজা পালন করা। মহান আল্লাহ রমজান মাসে সিয়াম পালনকে আমাদের উপর অত্যাবশকীয় করে দিয়েছেন এই জন্য যে এই মাসে অবতীর্ণ হয়েছে পবিত্র আল-কুরআন যা বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়াত এবং নিদর্শন ও সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী বিধান গ্রন্থ।
নিজ কু-প্রবৃত্তিকে দমন ও আত্মশুদ্ধির সর্বোত্তম মাস হলো রমজান। প্রথমত সিয়াম সাধনায় আল্লাহর নির্দেশ পালন করা হয়। দ্বিতীয়, রোজা দ্বারা সংযমী হওয়া যায়। তৃতীয়, রোজা দ্বারা অতীতের গুনাহসমূহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। পারতপক্ষে আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের সর্বোত্তম পন্থা হলো সিয়াম সাধনা। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। [সূরা বাকারা : ১৮৩]
উক্ত আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সিয়াম সাধনার দ্বারা তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জিত হয়।
এই পবিত্র মাসকে পূর্ণভাবে আল্লাহর রহমত, বরকত ও নাজাত প্রাপ্তির জন্য আমাদের কিছু করণীয় আছে এবং সেই সাথে কিছু বর্জনীয় কার্যাবলী রয়েছে যা পরিত্যাগ করার মাধ্যমে আমরা রমজান মাসকে কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী পালন করতে পারব। রমজান আমাদেরকে সংযমী হওয়ার শিক্ষা দেয়। শুধুমাত্র পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে দিনের বেলায় বিরত থাকাই সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে রমজান মাসে সার্বক্ষণিক নিজের কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে প্রকৃত তাকওয়া অর্জন করা সম্ভব। আমাদের ভুলে গেলে হবে না যে, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়টুকু রোজার অন্তুর্ভূক্ত নয়; বরং দিন ও রাত্রি উভয় সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে সিয়াম সাধনার প্রকৃত আত্মতৃপ্তি লাভ করা সম্ভব।
সিয়াম সাধানার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি হালাল খাদ্য ও পানীয়কে আল্লাহর নির্দেশের কারণে বর্জন করে প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে। সেই সাথে তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, দান-সদকাহ, কুরআন তিলাওয়াতসহ অন্যান্য ইবাদত করার মাধ্যমে তার আত্মার পরিশুদ্ধতা অর্জিত হয়। পবিত্র রমজান মাসে হাদিসে উল্লেখিত কতিপয় আমল দ্বারা আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারি :
১. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমত লাভের উদ্দেশ্যে সিয়াম সাধনা করা:
عن ابي هريرة  رضـ قال  قال رسول الله – صلى الله عليه وسلم: إذ دخل رمضان فتحت أبواب السماء وفي رواية فتحت أبواب الجنة وعلقت أبواب جهنم وسلسلت الشياطين وفى رواية فتحت أبواب الرحمة.
হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। অপর বর্ণনায় রয়েছে বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, দোযখের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় এবং শয়তানকে শৃংখলিত করা হয়। অপর বর্ণনায় আছে, রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। [বুখারী ও মুসলিম]
রমজান মাসে যেহেতু বেহেশতের ও রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় সেহেতু রোজা রেখে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর রহমতের আশা করব।
২. মুখ ও জিহ্বাকে সংযত রাখা
পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি নিজের মুখ ও জিহ্বাকে সংযত রাখতে হবে। মিথ্যা, অশ্লীল কথাবাতা, গালিগালাজ, গীবত, পরনিন্দা, অভিশাপ দেয়া ও চোগলখোরীসহ অন্যান্য অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। হাদিসে এসেছে-
عن أبي هريرة – رضـ قال قال رسول الله – صلى الله عليه وسلم: من لم يدع قول الزور والعمل به فليس الله حاجة فى أن يدع طعامه وشرابه.
অবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কর্ম পরিত্যাগ করেনি, তার পানাহার ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহর কোন কাজ নেয়। [মিশকাত : ১০৮৯, বুখারী]
৩. নিয়মিত তারাবীহর নামাজ আদায় করা
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তারাবীহ পড়তে হবে। কেননা, যে ব্যক্তি রমজানে তারাবীহ নামাজ পড়বে তার অতীতের সগীরা গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। হাদিসে এসেছে-
عن أبي هريرة – رضـ – قال: كان رسول الله – صلى الله عليه وسلم يرغب فى قيام رمضان من غير ان يأمرهم فيه بعزيمة فيقول من قال رمضان إيمانا واحتسابا غفرله ما تقدم م ذنبه.
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সা. রমজান মাসের নামাজ কাযেম করার জন্য উৎসাহ দান করতেন; কিন্তু তিনি এ বিষয়ে খুব তাকীদ করতেন না। বরং এরূপ বলতেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে নামায কায়েম করবে তার পূর্ববর্তী (সগীরা) গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হবে। [মুসলিম]
৪. কুরআন তিলাওয়াত করা :
নফল ইবাদতের মধ্যে সর্বোত্তম ইবাদত হলো কুরআন তিলাওয়াত করা। যেমন হযরত নুমান বিন বাশির রা. হতে বর্ণিত নবী করীম সা. ইরশাদ করেন –
أفضل عبادة أمتى تلاوة القرأن
আমার উম্মতের সবচেয়ে উত্তম ইবাদত কুরআন তিলাওয়াত করা। [বায়হাকী, শুআবুল ঈমান :হা. ১৮৬৯, মুসনাদুস শিহাব : ১১৯৫]
অন্য হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি রমজান মাসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নফল কাজ করবে সে ঐ ব্যক্তির সমান হলো যে, অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করল। [মিশকাত :১৮৬৮]
সুতরাং রমজান মাসে কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে আমরা অধিকতর সওয়াবের অধিকারী হবো।
৫. বেশি করে দান-সদকাহ করা
মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-
مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِئَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ.
যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মতো, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আর আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন (সওয়াবে) কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ অতি প্রাচুর্যময় (এবং) সর্বজ্ঞ। [সূরা বাকারাহ : ২৬১]
৬. নিজে ইফতার করার পাশাপাশি রোজাদারদের ইফতার করানো
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عن زيد بن خالد الجهني قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من فطر صائما كان له مثل أجره غير أنه لا ينقص من أجر الصائم شيئ.
হযরত যায়েদ বিন খালেদ জুহানী রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করালো তাকে রোজাদারের অনুরূপ সওয়াব দান করা হবে। কিন্তু রোজাদারের সওয়াবের কোন কমতি হবে না। [তিরমিযী : ৮০৭]
৭. মিসওয়াক করা : হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে,
عن عبد الله بن عامر بن ربيعة عن أبيه قال رأيت النبي صلى الله عليه وسلم ما لا أحصي يتسوك وهو صائم.
আব্দুল্লাহ বিন রবিআ রা. তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি নবী করীম সা. কে রোজা অবস্থায় অসংখ্যবার মিসওয়াক করতে দেখেছি। [তিরমিযী: হা.৭২৫]
৮. শীঘ্রই ইফতারী করা
হাদিস শরীফে এসেছে –
عن سهل قال قال رسول الله – صلى الله عليه وسلم- لا يزال الناس بخير ما عجلو الفطر.
হযরত সাহল ইবনে সা’দ রা. বলেন, আল্লাহ রাসূল সা. বলেছেন, মানুষ কল্যানের সাথে থাকবে যতকাল তারা শীঘ্রই ইফতার করবে। [বুখারী ও মুসলিম]
অন্য হাদিসে আছে, হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত রাসূল সা. বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমার বান্দাদের মধ্যে আমার কাছে তারাই বেশি প্রিয় যারা শীঘ্রই ইফতারী করে। [তিরমিযী, মিশকাত : ১৮৯৬]
৯. ইফতারের পূর্বে ও ইফতারের সময় দোয়া করা
হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. যখন ইফতার করতেন নিম্নের দোয়াটি পড়তেন :
اللهم لك صمت وعلى رزقك أفطرت تقبل مني إنك أنت السميع العليم.
হে আল্লাহ! আমি তোমার জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমার রিজিক দিয়ে ইফতার করছি। তুমি আমার এই রোজাকে কবুল কর। নিশ্চয় তুমি সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রোতা। [তাবারানী : ৮৪৫]
১০. বেশি করে ইসতেগফার ও দোয়া করা
এই রমজান মাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত্রি হলো লাইলাতুল কদর। হাদিস মোতাবেক রমজানের শেষের দশদিন বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করার কথা বলা হয়েছে। এই জন্য যে মহান আল্লাহ দেখতে চান লাইলাতুল কদরের বরকত ও ফজিলত লাভের উদ্দেশ্যে তার কোন বান্দা বেশি ইবাদত করে।
রাসূল সা. এই শেষ দশকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তা নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূল সা. কে লাইলাতুল কদরের কথা জিজ্ঞাসা করলাম, আজ কি দোয়া পাঠ করব? তিনি বললেন নিম্নের দোয়াটি পাঠ করবে:
اللهم إنك عفو تحب العفو فاعـف عنى.
হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল। তুমি ক্ষমাশীলতাকে ভালবাস। অতএব আমাকে ক্ষমা করো। [তিরমিযী : হা. ৩৫১৩, মুসনাদে আহমদ : ১/১৭১]
১১. খেজুর অথবা পানি দিয়ে ইফতার করা
হযরত সালমান আমের রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে, কেননা এতে বরকত রয়েছে।  যদি খেজুর না পায়, তবে যেন পানি দ্বারা ইফতার করে, এটি পবিত্রকারী। [আহমদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, দারেমী]
১২. সেহরী খেয়ে রোজা রাখা
সেহেরী খাওয়া সুন্নত। সেহেরী খেয়ে রোজা রাখার মধ্যে বরকত নিহিত রয়েছে। হাদিস শরীফে এসেছে-
عن أنس – رضـ – قال قال رسول الله – صلى الله عليه وسلم- تسحروا فإن فى السحور بركة.
আনাস বিন মালেক রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন- তোমরা সেহেরী খাবে। কেননা, সেহরীতে বরকত রয়েছে। [বুখারী, মুসলিম]
১৩. মসজিদে এতেকাফ করা
রমজানের শেষের দশদিনে এতেকাফ করা সুন্নত। পুরুষরা মসজিদে এবং স্ত্রীলোকেরা আপন ঘরে একটি স্থান ঘিরে নিয়ে তথায় এতেকাফ করবে। হাদিসে এসেছে-
عن عائشة- رضـ – أن النبي – صلى الله عليه وسلم- كان يعتكف العشر الأواخر من رمضان حتى توفاه الله،  ثم اعتكف أزواجه.
হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত যে, নবী করীম সা. রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন, যাবৎ না আল্লাহ তাকে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁর পর তাঁর স্ত্রীগণও এতেকাফ করেছেন। [বুখারী ও মুসলিম]
১৪. বেশি বেশি করে নফল নামাজ আদায় করা
হাদিস মোতাবেক রমজান মাসে একটি নফল ইবাদত করলে একটি ফরজ ইবাদতের সমান মর্যাদা পাওয়া যায়। হাদিসে এসেছে, হযরত আলী রা. বলেন, আমাকে হযরত আবু বকর রা. বলেছেন আর তিনি সত্য বলেছেন তিনি বলেছেন আমি রাসূল সা.কে বলতে শুনেছি যে, কোন ব্যক্তি গুনাহ করবে অতঃপর ওঠে আবশ্যকীয় পবিত্রতা লাভ করবে এবং নফল নামাজ পড়বে; তৎপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। [তিরমিযী, ইবনে মাজাহ]
১৫. বেশি করে আল্লাহর জিকির  ও তাসবীহ-তাহলীল করা
রমজান মাসে বেশি করে তাসবীহ পাঠ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্ঠা করতে হবে। মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন ,
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ.
আর যারা কোন অশ্ল¬ীল কাজ করে অথবা নিজেদের প্রতি যুলুম করে আল্ল¬াহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্ল¬াহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে ? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তা তারা বার বার করে না। [সূরা আল-ইমরান : ১৩৫]
১৬. রমজান মাসে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করা
রমজান মাসের শেষের দশদিনের বেজোড় রাত্রিতে লাইলাতুল কদরের জন্য বেশি করে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে এবং সারা বিশ্ববাসীর শান্তি, ক্ষমা ও স্থিতিশীলতার জন্য দোয়া করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ
লাইলাতুল কদর এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। [সূরা কদর : ৩]
১৭. রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করা :
রমজান মাসে এমন কিছু করা যাবে না যা শরীয়তপরিপন্থী। যেমন রোজাদারহীন ব্যক্তি রোজাদারদের সামনে পানাহার করা। সেই সাথে অশ্লীল ও অনৈতিক কার্যাবলী থেকে বিরত থাকতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন-
وَلا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ.
আর অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হবে নাÑ তা থেকে যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে। [সূরা আন-আম : ১৫১]
পরিশেষে বলতে চাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত ও সৎকর্মের মাধ্যমে এই রমজানের ফজিলত আমরা পূর্ণভাবে অর্জন করতে পারি। মহান আল্লাহ এই রমজান মাসে আমাদের উপর রহমত, রবকত ও মাগফেরাত প্রদান করুন এবং আমাদের জাহান্নাম থেকে নাজাত প্রদান করুন। আমিন।
কখন লাইলাতুল কদর তালাশ করবে?

কখন লাইলাতুল কদর তালাশ করবে?

রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করবে

রমজানের শেষ ১০ দিনে রয়েছে বরকতপূর্ণ রাত, লাইলাতুল কদর। আল্লাহ তাআলা এ মাসকে অন্য সব মাসের ওপর বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। আল্লাহ তাআলা এ উম্মতের প্রতি এ রাতের মর্যাদা ও কল্যাণ দান করে অনুগ্রহ করেছেন। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে এ রাতের ব্যাপারে বলেন,

﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةٖ مُّبَٰرَكَةٍۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ ٣ فِيهَا يُفۡرَقُ كُلُّ أَمۡرٍ حَكِيمٍ ٤ أَمۡرٗا مِّنۡ عِندِنَآۚ إِنَّا كُنَّا مُرۡسِلِينَ ٥ رَحۡمَةٗ مِّن رَّبِّكَۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٦ رَبِّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَمَا بَيۡنَهُمَآۖ إِن كُنتُم مُّوقِنِينَ ٧ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ يُحۡيِۦ وَيُمِيتُۖ رَبُّكُمۡ وَرَبُّ ءَابَآئِكُمُ ٱلۡأَوَّلِينَ ٨ ﴾ [الدخان: ٣، ٨]

‘নিশ্চয় আমি এটি নাজিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়, আমার নির্দেশে। নিশ্চয় আমি রাসূল প্রেরণকারী। তোমার রবের কাছ থেকে রহমত হিসেবে; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। যিনি আসমানসমূহ, জমীন ও এ দুয়ের মধ্যবর্তী সব কিছুর রব; যদি তোমরা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণকারী হও। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দেন। তিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের পিতৃপুরুষদের রব’। {দুখান : ৩-৮}

মহান আল্লাহ এ রাতের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন, যেহেতু এতে অত্যধিক কল্যাণ, বরকত ও মর্যাদা রয়েছে। যথা এ বরকতময় রাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যে কুরআন সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণকারী। এ রাতের গুরুত্বের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ ٢ لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ٣ تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ ٤ سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ ٥ ﴾ [القدر: ١، ٥]

‘নিশ্চয় আমি এটি আমি নাজিল করেছি ‘লাইলাতুল কদরে। তোমাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল কদর’ কী? ‘লাইলাতুল কদর’ হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরাইল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় সে রাত ফজরের সূচনা পর্যন্ত’। {সূরা কদর : ১-৫}

কদর শব্দটি সম্মান ও মর্যাদার অর্থে ব্যবহৃত হয়। আবার নির্ধারণ করা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। লাইলাতুল কদর অত্যধিক সম্মানিত ও মহত্বপূর্ণ। এ রাতে আল্লাহ তাআলা যা কিছু হবে তা নির্ধারণ করেন এবং প্রত্যেকটি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন।

হাজার মাসের চেয়ে উত্তম কথাটির অর্থ, এ রাতের মর্যাদা, সম্মান অত্যধিক, যা হাজার মাসের সম্মান ও মর্যাদার সমান। যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে এ রাতে নামাজ আদায় করবে তার পূর্বেকার সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।

ফেরেশতা ও রুহ নাজিল হবার অর্থ : ফেরেশতারা আল্লাহর এক প্রকার বান্দা, তারা রাতে দিনে আল্লাহর ইবাদতে দণ্ডায়মান থাকে। তারা লাইলাতুল কদরে কল্যাণ, বরকত ও রহমত নিয়ে পৃথিবীর বুকে আগমন করে। রুহ বলতে জিব্রাইল আলাইহিস সালামকে বুঝায়, এ রাতের বিষেশ মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রেখে তাকেও অবতরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

শান্তি বর্ষণ করার অর্থ : লাইলাতুল কদর এমন রাত, যে রাতে কোন ভীত সন্ত্রস্ত বান্দা যদি আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশের শান্তির বাণী শুনান।

ফজর উদয় হবার পূর্ব পর্যন্তের অর্থ : ফজর উদয়ের মাধ্যমে লাইলাতুল কদরের সমাপ্তি ঘটে।

মুদ্দাকথা, এ সূরার আলোকে আমরা লাই
লাতুল কদরের নিচের বৈশিষ্ট্যসমূহ চি‎‎হ্নিত করতে পারি :

(১) আল্লাহ তাআলা এ রাতে কুরআন নাজিল করেছেন, যা মানুষের জন্য সঠিক পথ নির্দেশিকা এবং যাতে দুনিয়া ও আখিরাতের বিশেষ কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

(২) এ রাতের গুরুত্ব ও মহত্ব অত্যধিক যা অন্য কোন রাতের ব্যাপারে বলা হয়নি।

(৩) এ রাত এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এ রাতে ইবাদত করার মাধ্যমে এক হাজার মাস ইবাদত করার সমান সাওয়াব অর্জন করা যায়।

(৪) এ রাতে ফেরেশতারা দুনিয়ার বুকে অবতরণ করে কল্যাণ, বরকত ও রহমত বর্ষণ করতে থাকে।

(৫) এটা শান্তি বর্ষণের রাত। যে বান্দা আল্লাহর ইবাদতে এ রাতটি অতিবাহিত করে আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্ত করে শান্তির বাণী শুনিয়ে দেন।

(৬) আল্লাহ এ রাতে মদীনায় একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাজিল করেছেন। যা কিয়ামত পর্যন্ত তেলাওয়াত করা হবে।

এছাড়া এ রাতের ফজিলত সমন্ধে বুখারী ও মুসলিম শরীফে আবূ হুরায়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

مَنْ قَامَ لَيْلَةُ الْقَدْرِ إِيْمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ

‘যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াব লাভের আশায় কদরের রাতে নফল সালাত আদায় ও রাত জেগে ইবাদত করবে আল্লাহ তার ইতোপূর্বের সকল সগীরা (ছোট) গুনাহ ক্ষমা করেদেন। [বুখারী : ১৯০১; মুসলিম : ৭৬০]

ঈমানের অর্থ, আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং আল্লাহ কদর রাতে নামাজ আদায়কারীর জন্য যে সাওয়াব নির্ধারণ করেছেন তার ওপর বিশ্বাস রাখা।

ইহতিসাবের অর্থ, পুরস্কারের আশা করা ও সওয়াব কামনা করা। তবে যে ব্যক্তি-ই এ রাতে ইবাদত করবে, সে-ই সওয়াব পাবে। তার সওয়াবের ধারণা থাক বা না-থাক। এ ধরনের নেকী অর্জনের জন্য সওয়াবে ধারণা থাকা শর্ত নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿ شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ ﴾ [البقرة: ١٨٥]

‘রমজান এমন একটি মাস যে মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে’। {বাকারা : ১৮৫}

আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেসা করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে লইলাতুল কদর সম্পর্কে বলুন, এটা কি রমজানে না অন্য কোন মাসে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা রমজান মাসেই। আবু যর আবার প্রশ্ন করলেন, এটা কি নবীগণ যতদিন জীবিত আছেন ততদিন অবশিষ্ট থাকবে? নাকি এটা কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। তবে এ রাতের মর্যাদা ও পুরস্কার আল্লাহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্নভাবে দিয়ে থাকেন।

লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ ১০ দিনে নিহিত রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

تَحَرُّوْا لَيْلَةُ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ

‘তোমরা রমাযানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত খোঁজ কর।’ [বুখারী : ২০১৭]

যারা বিশ্বনবী (সাঃ) এর রওজা থেকে তাঁর দেহাবশেষ চুরি করতে চেয়েছিলো!

যারা বিশ্বনবী (সাঃ) এর রওজা থেকে তাঁর দেহাবশেষ চুরি করতে চেয়েছিলো!

হিজরী ৫৫৭ সালের একরাতের ঘটনা। সুলতান নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) তাহাজ্জুদ ও দীর্ঘ মুনাজাতের পর ঘুমিয়ে পড়েছেন। চারিদিক নিরব নিস্তব্দ। কোথাও কোন সাড়া-শব্দ নেই। এমতাবস্থায় হঠাৎ তিনি স্বপ্নে দেখলেন স্বয়ং রাসুল (স) তার কামরায় উপস্থিত। তিনি কোন ভূমিকা ছাড়াই দু’জননীল চক্ষু বিশিষ্ট লোকের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, (নূরুদ্দীন) মাহমূদ! (এরা আমাকে বিরক্ত করছে), এ দুজন থেকে আমাকে মুক্ত কর।

এই ভয়াবহ স্বপ্ন দেখে নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গোটা কক্ষময় পায়চারি করতে লাগলেন। সাথে সাথে তার মাথায় বিভিন্ন প্রকার চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। হৃদয় রাজ্যে ভীড় জমাল হাজারও রকমের প্রশ্ন। তিনি ভাবলেন-

আল্লাহর রাসূল তো এখন কবরে জীবনে!

তার সাথে অভিশপ্ত ইহুদীরা এমন কী ষড়যন্ত্র করতে পারে?
কী হতে পারে তাদের চক্রান্তের স্বরুপ?

তারা কি রাসূল (স)-এর কোন ক্ষতি করতে চায়?

চায় কি পর জীবনেও তার সাথে ষড়যন্ত্র লিপ্ত হতে?

আমাকে দু’জন ইহুদীর চেহারা দেখানো হল কেন?

শয়তান তো আল্লাহর নবীর অবয়বে আসতে পারে না। তাহলে কি আমি সত্য স্বপ্ন দেখেছি?

এসব ভাবতে ভাবতে সুলতান অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি অজু-গোসল সেরে তাড়াতাড়ি দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। তারপর মহান আল্লাহর দরবারে ক্রন্দনরত অবস্থায় অনেকক্ষণ মুনাজাত করলেন। সুলতানের এমন কেউ ছিল না যার সাথে তিনি পরামর্শ করবেন। আবার এ স্বপ্নও এমন নয় যে, যার তার কাছে ব্যক্ত করবেন। অবশেষে আবারও তিনি শয়ন করলেন। দীর্ঘ সময় পর যখনই তার একটু ঘুমের ভাব এলো, সঙ্গে সঙ্গে এবারও তিনি প্রথম বারের ন্যায় নবী করীম (সা)কে স্বপ্নে দেখলেন। তিনি তাকে পূর্বের ন্যায় বলছেন, (নূরুদ্দীন) মাহমূদ! এ দুজন থেকে আমাকে মুক্ত কর।

এবার নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) “আল্লাহ্, আল্লাহ্” বলতে বলতে বিছানা থেকে উঠে বসলেন। তারপর কোথায় যাবেন, কী করবেন কিছুই ঠিক করতে পা পেরে দ্রুত অজু-গোসল শেষ করে মুসল্লায় দাড়িয়ে অত্যধিক ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় দু’রাকাত নামায আদায় করলেন এবং দীর্ঘ সময় অশ্রু সিক্ত নয়নে দোয়া করলেন।

রাতের অনেক অংশ এখনও বাকী। সমগ্র পৃথিবী যেন কি এক বিপদের সম্মুখীন হয়ে নিঝুম হয়ে আছে। কী এক মহা বিপর্যয় যেন পৃথিবীর বুকে সংঘটিত হতে যাচ্ছে । কঠিন বিপদের ঘনঘটা যেন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি মুখ তুলে আকাশ পানে তাকালেন। মনে হলো স্বপ্ন দেখা ঐ দু’জন লোক যেন তাকে ধরার জন্য দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসছে। তিনি সেই চেহারা দুটোকে মনের মনিকোষ্ঠা থেকে সরাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই তা সম্ভব হল না। শেষ পর্যন্তু নিরুপায় হয়ে নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) চোখ বন্ধ করে আবারও তন্দ্রা-বিভোর হয়ে শুয়ে পড়লেন।

শোয়ার পর তৃতীয়বারও তিনি একই ধরনের স্বপ্ন দেখলেন। রাসূল (সা)-এর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) ক্রন্দনরত অবস্থায় বিছানা পরিত্যাগ করলেন। এবার তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে, নিশ্চয়ই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মোবারক কোন না মহাবিপদের সম্মুখীন হয়েছে।

তিনি তড়িৎ গতিতে অজু-গোসল করে ফজরের নামায আদায় করলেন। নামায শেষে প্রধানমন্ত্রী জালালুদ্দীন মৌশুলীর নিকট গিয়ে গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে স্বপ্নের বিবরণ শুনালেন এবং এ মুহূর্তে কী করা যায়, এ ব্যাপারে সুচিন্তিত পরামর্শ চাইলেন।

জালালুদ্দীন মৌশুলী স্বপ্নের বৃত্তান্ত অবগত হয়ে বললে, “হুজুর! আপনি এখনও বসে আছেন? নিশ্চয়ই প্রিয় নবীর রওজা মোবারক কোন কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। তাই এ বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য বারবার তিনি আপনাকে স্মরণ করছেন। অতএব, আমার পরামর্শ হল, সময় নষ্ট না করে অতিসত্তর মদীনার পথে অগ্রসর হোন।” নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) আর কালবিলম্ব করলেন না। তিনি ষোল হাজার দ্রুতগামী অশ্রারোহী সৈন্য এবং বিপুল ধন সম্পদ নিয়ে বাগদাদ থেকে মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। রাত দিন সফর করে ১৭তম দিনে মদিনা শরীফে পৌঁছলেন এবং সৈন্য বাহিনীসহ গোছল ও অজু সেরে দু’ রাকাত নফল নামাজান্তে দীর্ঘ সময় ধরে মোনাজাত করলেন। তারপর সৈন্য বাহিনী দ্বারা মদিনা ঘেরাও করে ফেললেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আদেশ জারী করে দিলেন যে, বাইরের লোক মদিনায় আসতে পারবে, কিন্তু সাবধান! মদিনা থেকে কোন লোক বাইরে যেতে পারবে না।
নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) জুম্মার খোৎবা দান করলেন এবং ঘোষণা দিলেন, “আমি মদিনাবাসীকে দাওয়াত দিয়ে এক বেলা খানা খাওয়াতে চাই। আমার অভিলাষ, সকলেই যেন এই দাওয়াতে অংশ গ্রহণ করে।” সুলতান মদিনাবাসীকে আপ্যায়নের জন্য বিশাল আয়োজন করলেন এবং প্রত্যেকের নিকট অনুরোধ করলেন, মদিনার কোন লোক যেন এই দাওয়াত থেকে বঞ্চিত না হয়। নির্ধারিত সময়ে খাওয়া-দাওয়া শুরু হল। প্রত্যেকেই তৃপ্তিসহকারে খানা খেল। যারা দুরদুরান্ত থেকে আসতে পারেনি তাদেরকেও শেষ পর্যন্ত ঘোড়া ও গাধার পিঠে চড়িয়ে আনা হল। এভাবে প্রায় পনের দিন পর্যন্ত অগনিত লোক শাহী দাওয়াতে শরিক হওয়ার পর সুলতান জিজ্ঞাসা করলেন আরও কেউ অবশিষ্ট আছে কি? থাকলে তাদেরকেও ডেকে আন।

এই নির্দেশের পর সুলতান বিশ্বস্ত সূত্রে অবগত হলেন যে, আর কোন লোক দাওয়াতে আসতে বাকী নেই। একথা শুনে তিনি সীমাহীন অস্থির হয়ে পড়লেন। চিন্তার অথৈই সাগরে হারিয়ে গেলেন তিনি। ভাবলেন, যদি আর কোন লোক দাওয়াতে শরীক হতে বাকী না থাকে তাহলে সেই অভিশপ্ত লোক দু’জন গেল কোথায়? আমি তো দাওয়াতে শরীক হওয়া প্রতিটি লোককেই অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। কিন্তু কারও চেহারাইতো স্বপ্নে দেখা লোক দুটোর চেহারার সাথে মিলল না, তাহলে কি আমার মিশন ব্যর্থ হবে? আমি কি ঐ কুচক্রী লোক দুটোকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দিতে সক্ষম হব না? এসব চিন্তায় বেশ কিছুক্ষণ তিনি ডুবে রইলেন। তারপর আবারও তিনি নতুন করে ঘোষণা করলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মদিনার সকল লোকদের দাওয়াত খাওয়া এখনও শেষ হয়নি। অতএব সবাইকে আবারও অনুরোধ করা যাচ্ছে, যারা এখনও আসেনি তাদেরকে যেন অনুসন্ধান করে দাওয়াতে শরীক করা হয়।

একথা শ্রবণে মদিনাবাসী সকলেই এক বাক্যে বলে উঠল, “হুজুর! মদিনার আশে পাশে এমন কোন লোক বাকী নেই, যারা আপনার দাওয়াতে অংশ গ্রহণ করেনি।” তখন নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) বলিষ্ঠ কন্ঠে বললেন, “আমি যা বলেছি, ঠিকই বলেছি। আপনারা ভাল ভাবে অনুসন্ধান করুন।” সুলতানের এই দৃঢ়তা দেখে লক্ষাধিক জনতার মধ্য থেকে এক ব্যক্তি হঠাৎ করে বলে উঠল, “হুজুর! আমার জানামতে দু’জন লোক সম্ভবত এখনও বাকী আছে। তারা আল্লাহ্‌ওয়ালা বুযুর্গ মানুষ। জীবনে কখনও কারও কাছ থেকে হাদীয়া তোহফা গ্রহণ করেন না, এমনকি কারও দাওয়াতেও শরীক হন না। তারা নিজেরাই লোকদেরকে অনেক দান-খয়রাত করে থাকেন। নীরবতাই অধিক পছন্দ করেন। লোক সমাজে উপস্থিত হওয়া মোটেও ভালবাসেন না।”

লোকটির বক্তব্য শুনে সুলতানের চেহারায় একটি বিদ্যুত চমক খেলে গেল। তিনি কাল বিলম্ব না করে কয়েকজন লোক সহকারে ঐ লোক দুটোর আবাসস্থলে উপস্থিত হলেন। তিনি দেখলেন, এতো সেই দু’জন, যাদেরকে স্বপ্নে দেখানো হয়েছিল। তাদেরকে দেখে সুলতানের দু’চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কে তোমরা? কোথা থেকে এসেছ? তোমরা সুলতানের দাওয়াতে শরীক হলে না কেন?”

লোক দুটো নিজের পরিচয় গোপন করে বলল, “আমরা মুসাফির। হজ্বের উদ্দেশ্য এসেছিলাম। হজ্ব কার্য সমাধা করে জিয়ারতের নিয়তে রওজা শরীকে এসেছি। কিন্তু প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেমে আত্মহারা হয়ে ফিরে যেতে মনে চাইল না। তাই বাকী জীবন রওজার পাশে কাটিয়ে দেওয়ার নিয়তেই এখানে রয়ে গেছি। আমরা কারও দাওয়াত গ্রহণ করি না। এক আল্লাহর উপরই আমাদের পূর্ণ আস্থা। আমরা তারই উপর নির্ভরশীল। এবাদত, রিয়াজত ও পরকালের চিন্তায় বিভোর থাকাই আমাদের কাজ। কুরআন পাক তিলাওয়াত, নফল নামায ও অজিফা পাঠেই আমাদের সময় শেষ হয়ে যায়। সুতরাং দাওয়াত খাওয়ার সময়টা কোথায়?”
উপস্থিত জনগণ তাদের পক্ষ হয়ে বলল যে, “হুজুর! এরা দীর্ঘদিন যাবত এখানে অবস্থান করছে। এদের মত ভাল লোক আর হয় না। সব সময় দরিদ্র, এতিম ও অসহায় লোকদের প্রচুর পরিমাণে সাহায্য করে। তাদের দানের উপর অত্র লোকদের প্রচুর পরিমাণে জীবিকা নির্ভর করে।” নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) লোকদের কথা শুনে লোক দুটোর প্রতি পুনরায় গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন। অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে তাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলেন। এতে আবারও তিনি নিশ্চিত হলেন, এরা তারাই যাদেরকে তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন।

এবার সুলতান জলদ গম্ভীর স্বরে তাদেরকে বললেন, “সত্য কথা বল। তোমরা কে? কেন, কী উদ্দেশ্যে এখানে থাকছ?”

এবারও তারা পূর্বের কথা পুনরাবৃত্তি করে বলল, “আমরা পশ্চিম দেশ থেকে পবিত্র হজ্বব্রত পালনের জন্য এখানে এসেছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নৈকট্য লাভই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। এ উদ্দেশ্যেই আমরা এখানে অবস্থান করছি।” সুলতান এবার কারও কথায় কান না দিয়ে তাদেরকে সেখানে আটক রাখার নির্দেশ দিলেন, অত:পর স্বয়ং তাদের থাকার জায়গায় গিয়ে খুব ভাল করে অনুসন্ধাণ চালালেন। সেখানে অনেক মাল সম্পদ পাওয়া গেল। পাওয়া গেল বহু দুর্লভ কিতাবপত্র। কিন্তু এমন কোন জিনিষ পাওয়া গেল না, যা দ্বারা স্বপ্নের বিষয়ে কোন প্রকার সহায়তা হয়।

নূরুদ্দীন জাঙ্কি(র:) অত্যধিক পেরেশান, অস্থির। এখনও রহস্য উদঘাটন করতে না পারায় তিনি সীমাহীন চিন্তিত। এদিকে মদীনায় বহু লোক তাদের জন্য সুপারিশ করছে। তারা আবারও বলছে, “হুজুর! এরা নেককার বুযুর্গ লোক। দিনভর রোজা রাখেন। রাতের অধিকাংশ সময় ইবাদত বন্দেগীতে কাটিয়ে দেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই রওজা শরীফের নিকটে এসে আদায় করেন। প্রতিদিন নিয়মিত জান্নাতুল বাকী যিয়ারত করতে যান। প্রতি শনিবার মসজিদুল কোবাতে গমন করেন। কেউ কিছু চাইলে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না।”


সুলতান তাদের অবস্থা শুনে সীমাহীন আশ্চর্যবোধ করলেন। তথাপি তিনি হাল ছাড়ছেন না। কক্ষের অংশে অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফিরিয়ে যাচ্ছেন। ঘরের প্রতিটি বস্তুকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। কিন্তু সন্দেহ করার মত কিছুই তিনি পাচ্ছেন না।

নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) এক পর্যায়ে সঙ্গীদের বললেন- “আচ্ছা, তাদের নামাযের মুসাল্লাটা একটু উঠাও দেখি।” সঙ্গীরা নির্দেশ পালন করল। নামাযের মুসল্লাটি বিছানো ছিল একটি চাটাইয়ের উপর। সুলতান আবার নির্দেশ দিলেন, “চাটাইটিও সরিয়ে ফেল।”

চাটাই সরানোর পর দেখা গেল একখানা বিশাল পাথর। সুলতানের নির্দেশে তাও সরানো হল। এবার পাওয়া গেল এমন একটি সুরঙ্গপথ যা বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে। এমনকি তা পৌছে গেছে, রওজা শরীফের অতি সন্নিকটে। এ দৃশ্য অবলোকন করা মাত্র নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) বিজলী আহতের ন্যায় চমকে উঠলেন। অস্থিরতার কালো মেঘ ছেয়ে যায় তার সমস্ত হৃদয় আকাশে। ক্রোধে লাল হয়ে যায় গোটা মুখমন্ডল। অবশেষে লোক দুটোকে লক্ষ্য করে ক্ষিপ্ত-ক্রদ্ধ সিংহের ন্যায় গর্জন করে ঝাঁঝাঁলো কন্ঠে বললেন-

“তোমরা পরিস্কার ভাষায় সত্যি কথাটা খুলে বল, নইলে এক্ষুনি তোমাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সম্মুক্ষিন হতে হবে। বল, তোমরা কে? তোমাদরে আসল পরিচয় কী? কারা, কী উদ্দেশ্যে তোমাদেরকে এখানে পাঠিয়েছে?”

সুলতানের কথায় তারা ঘাবড়ে গেল। কঠিন বিপদ সামনে দেখে আসল পরিচয় প্রকাশ করে বলল,-

“আমরা ইহুদী। দীর্ঘদিন যাবত আমাদেরকে মুসল শহরের ইহুদীরা সুদক্ষ কর্মী দ্বারা প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রচুর অর্থ সহকারে এখানে পাঠিয়েছে। আমাদেরকে এজন্য পাঠানো হয়েছে যে, আমরা যেন কোন উপায়ে মুহাম্মদ (স)-এর শবদেহ বের করে ইউরোপীয় ইহুদীদের হাতে হস্তান্তর করি। এই দুরূহ কাজে সফল হলে তারা আমাদেরকে আরও ধনসম্পদ দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সুলতান বললেন, “তোমরা তোমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কী পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলে? কিভাবে তোমরা কাজ করতে?”

তারা বলল, “আমাদের নিয়মিত কাজ ছিল, রাত গভীর হলে অল্প পরিমাণ সুড়ঙ্গ খনন করা এবং সাথে ঐ মাটিগুলো চামড়ার মজকে ভর্তি করে অতি সন্তর্পণে মদীনার বাইরে নিয়ে ফেলে আসা। আজ দীর্ঘ তিন বৎসর যাবত এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে আমরা অনবরত ব্যস্ত আছি। যে সময় আমরা রওজা মোবারকের নিকট পৌছে গেলাম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম যে, এক সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বনবীর লাশ বের করে নিয়ে যাব, ঠিক সে সময় ধরে আমাদের মনে হল, আকাশ যেন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। জমীন যেন প্রচন্ড ভূমিকম্পে থরথর করে কাঁপছে। যেন সমগ্র পৃথিবী জুড়ে মহাপ্রলয় সংঘটিত হচ্ছে। অবস্থা এতটাই শোচনীয় রূপ ধারণ করল, মনে হল সুড়ঙ্গের ভিতরেই যেন আমরা সমাধিস্থ হয়ে পড়ব। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে আমরা কাজ বন্ধ করে রেখেছি।”

তাদের বক্তব্যে সুলতানের নিকট সব কিছুই পরিস্কার হয়ে গেল। তাই তিনি লোক দুটোকে নযীর বিহীন শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন । যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এমন দু:সাহস দেখাতে না পারে। তিনি মসজিদ হতে অর্ধ মাইল দূরে একটি বিশাল ময়দানে বিশ তাহ উঁচু একটি কাঠের মঞ্চ তৈরী করলেন। সাথে সাথে সংবাদ পাঠিয়ে মদীনা ও মদীনার আশেপাশের লোকদেরকে উক্ত ময়দানে হাজির হওয়ার নির্দেশ প্রদান করলেন।

নির্ধারিত সময়ে লক্ষ লক্ষ লোক উক্ত মাঠে সমবেত হল। সুলতান নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) অপরাধী লোক দুটোকে লৌহ শিকলে আবদ্ধ করে মঞ্চের উপর বসালেন । তারপর বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে তাদের হীন চক্রান্ত ও ঘৃণ্য তৎপরতার কথা উল্লেখ করলেন।

সুলতান নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) -এর বক্তব্য শ্রবণ করে লোকজন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। তারা এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করল। সুলতান বললেন- হ্যাঁ, এদের শাস্তি দৃষ্টান্তমূলকই হবে।

তিনি লোকদেরকে বিপুল পরিমাণ লাকড়ী সংগ্রহের নির্দেশ দিলেন। তারপর লক্ষ জনতার সামনে সেই ইহুদী দুটোকে মঞ্চের নিম্নভাগে আগুন লাগিয়ে পুড়ে ভস্ম করে ফেলেন। কোন কোন বর্ণনায় আছে, সেই আগুন নাকি দীর্ঘ এগার দিন পর্যন্ত জ্বলছিল।

অত:পর তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এক হাজার মন সিসা গলিয়ে রওজা শরীফের চতুষ্পার্শে মজবুত প্রাচীর নির্মাণ করে দেন। যেন ভবিষ্যতে আর কেউ প্রিয় নবীজির কবর পর্যন্ত পৌছাতে সক্ষম না হয়। তারপর তিনি কায়মনোবাক্যে আল্লাহ্‌পাকের শুকরিয়া আদায় করলেন এবং তাকে যে এত বড় খেদমতের জন্য কবুল করা হল সেজন্য সপ্তাহকাল ব্যাপী আনন্দাশ্রু বিসর্জন দিলেন।

ইতিহাসের পাতা থেকে অবগত হওয়া যায় যে, নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) ইন্তিকাল করলে অসীয়ত মোতাবেক তার লাশকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মোবারকের 
অতি নিকটে দাফন লরা হয়।
লাইলাতুল্ কদর’ এ কি কি ইবাদত করবেন?

লাইলাতুল্ কদর’ এ কি কি ইবাদত করবেন?

লাইলাতুলকদরের জন্য আপনি প্রথমতঃ আল্লাহ তাআ’লা আমাদের বলে দিয়েছেন যে, এই রাত এক হাজার মাসের থেকেও উত্তম। অর্থাৎ এই এক রাতের ইবাদত এক হাজার মাসের থেকেও উত্তম। [আল্ মিসবাহ আল্ মুনীর/১৫২১] 
তাই এই রাতটি ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করাই হবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয়তঃ জানা দরকার যে ইবাদত কাকে বলে? ইবাদত হচ্ছে, প্রত্যেক এমন আন্তরিক ও বাহ্যিক কথা ও কাজ যা, আল্লাহ পছন্দ করেন এবং তাতে সন্তুষ্ট থাকেন। [মাজমুউ ফাতাওয়া,১০/১৪৯]

উক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যেতে পারে যে ইবাদত বিশেষ এক-দুটি কাজে সীমাবদ্ধ নয়। তাই আমরা একাধিক ইবাদতের মাধ্যমে এই রাতটি অতিবাহিত করতে পারি। নিম্নে কিছু উৎকৃষ্ট ইবাদত উল্লেখ করা হলঃ

১- ফরয নামায সমূহ ঠিক সময়ে জামাআ’তের সাথে আদায় করা। 
যেমন মাগরিব, ইশা এবং ফজরের নামায। তার সাথে সাথে সুন্নতে মুআক্কাদা, তাহিয়্যাতুল মসজিদ সহ অন্যান্য মাসনূন নামায আদায় করা।

২- কিয়ামে লাইলাতুল্ কদর করা। 
অর্থাৎ রাতে তারবীহর নামায আদায় করা। নবী (সাঃ) বলেনঃ 
“যে ব্যক্তি ঈমান ও নেকীর আশায় লাইলাতুল কদরে কিয়াম করবে (নামায পড়বে) তার বিগত গুনাহ ক্ষমা করা হবে”। [ফাতহুল বারী,৪/২৯৪] 
এই নামায জামাআতের সাথে আদায় করা উত্তম। অন্যান্য রাতের তুলনায় এই রাতে ইমাম দীর্ঘ কিরাআতের মাধ্যমে নামায সম্পাদন করতে পারেন। ইশার পর প্রথম রাতে কিছু নামায পড়ে বাকী নামায শেষ রাতে পড়াতে পারেন। একা একা নামায আদায়কারী হলে সে তার ইচ্ছানুযায়ী দীর্ঘক্ষণ ধরে নামায পড়তে পারে।

৩- বেশী বেশী দুআ করা। 
তন্মধ্যে সেই দুআটি বেশী বেশী পাঠ করা যা নবী (সাঃ) মা আয়েশা (রাযিঃ) কে শিখিয়েছিলেন। 
মা আয়েশা নবী (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি লাইলাতুল কদর লাভ করি, তাহলে কি দুআ করবো? তিনি (সাঃ) বলেনঃ বলবে, (আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল্ আফওয়া ফা’ফু আন্নী”। [আহমদ,৬/১৮২] অর্থ, হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল। ক্ষমা পছন্দ কর, তাই আমাকে ক্ষমা কর”।

এছাড়া বান্দা পছন্দ মত দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর যাবতীয় দুআ করবে। সে গুলো প্রমাণিত আরবী ভাষায় দুআ হোক কিংবা নিজ ভাষায় হোক। এ ক্ষেত্রে ইবাদতকারী একটি সুন্দর সহীহ দুআ সংকলিত দুআর বইয়ের সাহায্য নিতে পারে। সালাফে সালেহীনদের অনেকে এই রাতে অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে দুআ করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কারণ এতে বান্দার মুক্ষাপেক্ষীতা, প্রয়োজনীয়তা ও বিনম্রতা প্রকাশ পায়, যা আল্লাহ পছন্দ করেন।

৪- যিকর আযকার ও তাসবীহ তাহলীল করা। 
অবশ্য এগুলো দুআরই অংশ বিশেষ। কিন্তু বিশেষ করে সেই শব্দ ও বাক্য সমূহকে যিকর বলে, যার মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করা হয়। যেমন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, “আল্ হামদু ল্লিল্লাহ” “সুবহানাল্লাহ”, “আল্লাহুআকবার” “আস্তাগফিরুল্লাহ”, “লা হাওলা ওয়ালা কুউআতা ইল্লা বিল্লাহ”। ইত্যাদি।

৫- কুরআন তিলাওয়াত। 
কুরআন পাঠ একটি বাচনিক ইবাদত, যা দীর্ঘ সময় ধরে করা যেতে পারে। যার এক একটি অক্ষর পাঠে রয়েছে এক একটি নেকী। নবী (সাঃ) বলেনঃ 
“যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি অক্ষর পড়বে, সে তার বিনিময়ে একটি নেকী পাবে… আমি একথা বলছি না যে, আলিফ,লাম ও মীম একটি অক্ষর; বরং আলিফ একটি অক্ষর লাম একটি অক্ষর এবং মীম একটি অক্ষর”। [তিরমিযী, তিনি বর্ণনাটিকে হাসান সহীহ বলেন]
এছাড়া কুরআন যদি কিয়ামত দিবসে আপনার সুপারিশকারী হয়, তাহলে কতই না সৌভাগ্যের বিষয়! নবী (সাঃ) বলেনঃ 
“তোমরা কুরআন পড়; কারণ সে কিয়ামত দিবসে পাঠকারীর জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে”। [মুসলিম]

৬- সাধ্যমত আল্লাহর রাস্তায় কিছু দান-সাদকা করা। 
নবী (সাঃ) বলেনঃ 
“সাদাকা পাপকে মুছে দেয়, যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়”। [সহীহুত তারগবি]

শবে কদরের একটি রাতে এই রকম ইবাদতের মাধ্যমে আপনি ৮৩ বছর ৪ মাসের সমান সওয়াব অর্জন করতে পারেন। ইবাদতের এই সুবর্ণ সুযোগ যেন হাত ছাড়া না হয়। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। আমীন!
উল্লেখ থাকে যে, ইবাদতের উদ্দেশ্যে বৈষয়িক কাজ-কর্মও ইবাদতে পরিণত হয়। যেমন রোযার উদ্দেশ্যে সাহরী খাওয়া, রাত জাগার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম সেরে নেওয়া। তাই লাইলাতুল কদরে ইবাদতের উদ্দেশ্যে বান্দা যেসব দুনিয়াবী কাজ করে সেগুলোও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।
আশা করি আপনাদের বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত কিছু আইডিয়া দিতে পেরেছি। ওয়ামা তাওফীক ইল্লা বিল্লাহ্