রমজা মাসেরসিয়াম বা রোজা এমনই ইবাদত যার মধ্যে রয়েছে আল্লাহ ভীতি, সর্বোন্নত পুরস্কারপ্রাপ্তি, মানবতার প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নফস বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে একটি সফল পরিবর্তন আনয়নের মাস। মুসলিম ঐতিহ্য চেতনার স্মারক, দ্বীন দুনিয়ার সমৃদ্ধি, পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা, শারীরিক ও মানসিক শ্রেষ্ঠত্ব আর গৌরব ও মর্যাদার অবিস্মরণীয় অম্লান স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে এ মাহে রমজান।
আমাদের বাংলা ভাষায় আমরা রোজা বলি। মূলত শব্দটি ফারসি পরিভাষা। আরবি ভাষায় একে বলা হয় সাওম। বহুবচনে সিয়াম। সাওম শব্দের আবিধানিক অর্থ বিরত থাকা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সাওমের নিয়তে যাবতীয় পানাহার ও ইন্দ্রিয় সম্ভোগ থেকে বিরত থাকাকেই বলা হয় সিয়াম বা রোজা। পবিত্র কোরআনে রোজা সম্পর্কে
সূরা বাকারাহ'র ১৮৩তম আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ (183)
"হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা তকাওয়াবান (মুত্তাকিন) হতে পারো।
এ আয়াতাংশ এটাই বলা হয়েছে যে, রোজা শুধু উম্মতে মোহাম্মদির উপর ফরজ হয়নি বরং অন্য নবীদের যুগেও এটা ফরজ ছিল। ঐতিহাসিক তথ্যে জানা যায়, পৃথিবীর প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) এর যুগ থেকে হজরত ঈসা (আ.) এর যুগ পর্যন্ত পূর্ববর্তী উম্মতদের মধ্যেও রোজার প্রচলন ছিল, অবশ্য সেই রোজার ধরন ও প্রকৃতি আমাদের মতো ছিল না। হজরত আদমের (আ.) উপর প্রতি চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা ফরজ ছিল। হজরত নুহ (আ.) দুই ঈদের দুই দিন ছাড়া সর্বদা রোজা রাখতেন। হজরত দাউদ (আ.) একদিন রোজা রাখতেন আর একদিন বাদ দিতেন। হজরত মুসার (আ.) উম্মতরা আশুরার রোজা রাখতেন। হজরত ঈসা (আ.) একদিন রোজা রাখতেন আর পরবর্তী দু’দিন বাদ দিতেন। মুসলিম শরিফের একটি হাদিস থেকে জানা যায়, হজরত দাউদ (আ.) রোজা পালন করতেন।
বর্তমান বিশ্বের বহুল প্রচলিত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি প্রভৃতি ধর্মগুলো ছাড়াও প্রাচীন গ্রিক মিসরীয় ইরানি ও ভারতীয় ধর্মগুলোতেও কোনো না কোনোভাবে রোজা বা উপবাসব্রত বিদ্যমান ছিল। হিন্দু ধর্মের নানা আচার-অনুষ্ঠানের একটি বিশিষ্ট উপাসনা হচ্ছে উপবাস (আরকানে আরবা: সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নাদভী)।
তাওরাত ও ইনজিলের দ্বারা ঈসায়ীদের এবং ইহুদিদের ৪০ রোজা পালন প্রমাণিত হয়। কিন্তু বর্তমানে তাদের লাখোজনের মধ্যেও দু’চারজন রোজা পালন করেন কিনা সন্দেহ।
আহলে কিতাবগণ ইফতারের পর এশার সময় পানাহার করে নিতেন এবং ঘুম থেকে ওঠার পরদিন দিবাগত রাত এশা পর্যন্ত কিছু খেতেন না (ওয়াজে রোজা)।
উম্মতে মোহাম্মদি রাসূল সা.এর উম্মতের উপর রোজা একটি অবশ্য পালনীয় ইবাদত। ইসলামের মূল পাঁচটি বুনিয়াদের তৃতীয় বুনিয়াদ হলো রোজা। মানবজাতির জন্য এর মধ্যে রয়েছে পার্থিব এবং অপার্থিব উভয় কল্যাণ। ইমাম বুখারি (রা.) আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, রোজা মুমিনের ঢালস্বরূপ। এতে অশ্লীলতা ও মূর্খতা পরিহার করবে, কোনো ব্যক্তি মারামারি বা গালাগালি করতে প্রবৃত্ত হলে দুবার বলবে, আমি রোজা পালন করছি। যার হাতে আমার প্রাণ সেই আল্লাহর শপথ সিয়াম পালনকারীর মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর কাছে মিশকের (মৃগনাভীর) ঘ্রাণ অপেক্ষা অধিকতর উত্তম।
আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালা আমাদেরকে রোজার পূর্ণ হক আদায় করে এ মাসের রহমত,বরকত ও মাগফিরাত হাসিলের তাওফিক দান করুন।
আমিন।