মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রমজানের ঐতিহাসিক পটভূমির প্রতি ইঙ্গিত করে ইরশাদ করেন : হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমন তোমাদের পূর্বসূরিদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। এ পবিত্র আয়াতে সব শরিয়তেই রোজা ফরজ ছিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
হজরত আদমের (আ.) যুগে রোজা : পূর্বের শরিয়তসমূহে রোজা কোন ধরনের বা কত দিনের ছিল, কোন মাস অথবা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত ছিল কি না, এ সম্পর্কে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অত্যন্ত মুশকিল। হজরত আল্লামা আলূসীর মতে, হজরত আদমের প্রতিও রোজার হুকুম ছিল, কিন্তু সেই রোজার বিস্তৃত বর্ণনা আমাদের জানা নেই। অন্যান্য তাফসির বিশারদও এই ধরনের মত পোষণ করেছেন। এ সম্পর্কে ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা আরিফ বিল্লাহ শাইখুল হিন্দ আল্লামা মাহমুদুল হাসান (রহ.) উপরোক্ত আয়াতের তাফসিরে বলেন : 'রোজার হুকুম যথারীতি হজরত আদমের (আ.) যুগ হতে শুরু করে অদ্যাবধি বিদ্যমান রয়েছে।
হজরত নূহের যুগে রোজা : হজরত নূহ (আ.)-এর যুগে বিস্তৃত শরিয়ত অবতীর্ণ হয়। হজরত নূহের পূর্বেও শরীয়ত ছিল। কিন্তু পৃথিবীর তখন প্রথম যুগ, তাই সেই যুগে শরিয়তের বিষয়াদির অহি ছিল অত্যন্ত সীমিত। সেই যুগে বেশির ভাগই ছিল পৃথিবী গড়ার প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি সংক্রান্ত অহি। আর এই প্রশ্নে হজরত নূহের যুগ ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র। এই যুগ থেকেই শুরু হয় খোদাদ্রোহিতা ও অহির আদেশের অমান্যতা। হজরত নূহকে লক্ষ্য করেই আল্লাহপাক ইরশাদ করেন : 'যারা ইমান এনেছে, তারা ব্যতীত আর কেউই ইমান আনবে না।' তখন হজরত নূহ (আ.) অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেছিলেন : 'হে আমার রব! পৃথিবীর বুকে কোনো কাফেরের গৃহ যে অবশিষ্ট না থাকে।' হাশরের ময়দানে শাফাআতের জন্য উম্মতগণ সর্বপ্রথম হজরত নূহের কাছে গমন করবে। হজরত নূহ (আ.)-কে পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম রসুল হিসেবে ঘোষণা করে বলা হয়েছে : 'আপনি বিশ্ববাসীর মাঝে শরিয়ত বর্ণনাকারী প্রথম রসুল।' আল্লামা ইবনে কাছীর স্বীয় প্রসিদ্ধ তাফসিরে লিখেছেন, হজরত নূহের যুগ থেকে প্রত্যেক মাসেই তিনটি রোজা পালন করার হুকুম ছিল এবং এ হুকুম বিশ্ব নবীর (সা.) যুগ পর্যন্ত বহাল ছিল। অতঃপর যখন রমজানে রোজা পালনের হুকুম হলো, তখন থেকে প্রতি মাসে তিনটি রোজা পালনের হুকুম রহিত হলো। এই বর্ণনার দ্বারা সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, হজরত নূহের যুগেও রোজার বিধান চালু ছিল।
হজরত মূসার যুগে রোজা : যখন আল্লাহপাক হজরত মূসা (আ.)-কে তূর পর্বতে ডেকে তাওরাত প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন, তখন আল্লাহপাক হজরত মূসাকে সেখানে ত্রিশ রাত অবস্থানের নির্দেশ দিলেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : 'এবং স্মরণ কর ওই সময়কে, যখন আমি মূসার জন্য ত্রিশ রাত নির্ধারণ করেছিলাম এবং আরও দশ দ্বারা এটা পূর্ণ করেছিলাম। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত চল্লিশ রাত পূর্ণ হয়। হজরত ইবনে আব্বাসের মতে হজরত মূসা (আ.) জিলকদ মাসের ৩০ দিন ও জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন রোজা পালন করে আল্লাহর দরবারে হাজির হন এবং তাওরাত লাভ করেন। এ বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় যে, হজরত মূসা (আ.)-এর যুগেও রোজার হুকুম ছিল।
হজরত দাউদের যুগে রোজা : হজরত ইবনে আমরকে রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজা পালনের আদেশ এভাবে করেছিলেন : 'আল্লাহর কাছে যে রোজা উত্তম সেই রোজা রাখ। আর সেই রোজা হলো যা দাউদ রেখেছেন। তিনি একদিন রোজা রাখতেন আর একদিন ইফতার করতেন। এই হাদিস থেকে হজরত দাউদ (আ.)-এর যুগের রোজার সন্ধান পাওয়া যায়।
বাইবেলে রোজা : বাইবেলে 'দার' বাদশাহের যুগে বাইতুল ইলের বাসিন্দা ও বনী ইয়াহুদাদের প্রতি রোজা রাখার হুকুমের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এমনিভাবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সব শরিয়তেই রোজার সন্ধান পাওয়া যায়। বস্তুত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব জাতির মধ্যেই রোজা পালনের বিধান ছিল।
আত্দশুদ্ধির তাগিদে আদিকাল থেকেই বিভিন্ন বর্ণ, গোত্র ও ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রোজা প্রচলিত ছিল। প্রাচীন চীনা সম্প্রদায়ের লোকরা একাধারে কয়েক সপ্তাহ রোজা রাখত। অনুরূপভাবে খ্রিস্টান পাদ্রী, পারসিক অগ্নিপূজক এবং হিন্দু-যোগীদের মধ্যেও রোজার রেওয়াজ ছিল। পারসিক ও হিন্দু যোগীদের রোজার প্রকৃতি ছিল এইরূপ যে, তারা রোজা থাকা অবস্থায় মাছ-মাংস, তরিতরকারি ইত্যাদি ভক্ষণ করা হতে বিরত থাকত বটে, কিন্তু ফলমূল ও পানীয় গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকত না। কিন্তু ইসলামে রোজার যে নীতি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা এ দুই বিপরীতমুখী প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ। আরবিতে এই অবস্থাকে এ'তেদাল বলা যেতে পারে। ইসলামে রোজা এক দিকে যেমন কঠোরতা মুক্ত, অপরদিকে সর্ব প্রকার বাতুলতা থেকেও পবিত্র। অর্থাৎ ইসলামে দীর্ঘ সময় একাধারে রোজা রাখাও যেমন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনিভাবে রোজাদারকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার থেকেও বিরত থাকতে বলা হয়েছে।