রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

রোজা ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ ও শ্রেষ্ঠ ইবাদত। আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধিতা, ধৈর্য ও তাকওয়া অর্জনের অন্যতম প্রধান উপায় রোজা। এ ইবাদতের মাধ্যমেই মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয়। আল্লাহভীতি বা তাকওয়া অর্জন এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনেও সাওম বা রোজা অপরিহার্য ও অনিবার্য ইবাদত। মানুষের নৈতিক উন্নয়ন ও দৈহিক শৃংখলা বিধান, পারস্পরিক সম্প্রীতি-সহানুভূতি এবং সামাজিক সাম্য ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও সাওম বা রোজার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সাওম আরবি শব্দ। বাংলায় আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, কঠোর সাধনা, আত্মসংযম ইত্যাদি। সাধারণত প্রভাতের সাদা আভা প্রকাশের সময় (সুবহে সাদিক) থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যাবতীয় ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকার কঠোর সাধনাকে সাওম বা রোজা বলা হয়। রমজান মাসে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ-সবল জ্ঞানসম্পন্ন মুসলিম নর-নারীর ওপর রোজা রাখা ফরজ। অবশ্য রোজা পালনে অক্ষম, অসুস্থ, মুসাফির বা পর্যটক ব্যক্তিদের পরবর্তীকালে রোজা পালনের সুযোগ দিয়েছে ইসলাম। আল কুরআনের ভাষায়, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রমজান মাসে উপস্থিত হয় সে যেন রোজা রাখে। আর যে ব্যক্তি অসুস্থ হয় অথবা সফরে থাকে সে যেন পরবর্তী দিনগুলোতে তা আদায় করে’ (বাকারা-১৮৬)।
মহানবী সা: রমজান মাসের রোজাকে ফরজ আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘তোমাদের নিকট তাকওয়ার মাস রমজানের আগমন হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর এ মাসের রোজাকে ফরজ করে দিয়েছেন’ (নাসাঈ, আহমদ, তিরমিজি, ইবনে মাজা)
অর্থাৎ প্রত্যেক স্বাধীন সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিম নর-নারীর ওপর রোজা আবশ্যিক ইবাদত। কোনো মুসলিম রমজান মাসের রোজাকে অস্বীকার করলে কাফের হিসেবে গণ্য হবে। আর বিনা কারণে ইচ্ছাপূর্বক রোজা না রাখলে তার জন্য কাফ্ফারা আদায় অপরিহার্য করা হয়েছে আল-কুরআনে। আত্মসংযম ও আধ্যাত্মিক উন্নতিতে রোজার গুরুত্ব এত ব্যাপক যে প্রত্যেক নবী-রাসূলের অনুসারীদের ওপর তা অপরিহার্য ছিল। আল কুরআনের ভাষায়, ‘তোমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা মুত্তাকি বা আল্লাহভীরু হতে পারো’ (বাকারা-১৮৪)।
কালের বিবর্তনে ও সময়ের পরিবর্তনে প্রত্যেক জাতির রোজার পদ্ধতি ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য অভিন্ন। আর তা হলো আধ্যাত্মিক উন্নতি-আল্লাহভীতি অর্জন। আধ্যাত্মিক উন্নতি অর্জনের জন্য আহলে কিতাব বা ঐশী ধর্মগুলো ছাড়াও অন্যান্য ধর্মে বিভিন্নভাবে আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়া হয়। যেমন হিন্দুধর্মের উপবাস, বৌদ্ধ ধর্মের সংসার ত্যাগ আধ্যাতিক উন্নতির সোপান বলে মনে করা হয়। আর ইসলামী বিধান অনুযায়ী আধ্যাত্কিতা অর্জনের প্রধান মাধ্যম রমজান মাসের সিয়াম সাধনা। অর্থাৎ রোজার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধিত হয়। রোজা শুধু আবশ্যকীয় ইবাদতই নয়; বরং আত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধনেও এর ভূমিকা ব্যাপক। কাম-ক্রোধ, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি মানবিক কুপ্রবৃত্তি থেকে দূরে রাখে রোজা। শয়তানের প্ররোচনা ও নফসের কুমন্ত্রণা থেকে আত্মাকে হেফাজত রাখতেও রোজার ভূমিকা অগ্রগণ্য। এ জন্যই রাসূল সা: রোজাকে ‘ঢাল’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রোজার মাধ্যমেই একজন মুসলিম কৃচ্ছ্র সাধন করে নিজেকে আত্মসংযমী করে গড়ে তুলতে পারে। সিয়ামের কঠোর শৃংখলা ও নিয়ন্ত্রণ রোজাদারকে প্রকৃত মুসলিম হওয়ার সুযোগ করে দেয়। মুসলমানেরা রোজার মাধ্যমেই মহান আল্লাহর সাথে গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। রোজার মাধ্যমেই মানবহৃদয়ে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়। রোজাদার ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়েও শুধু মহান আল্লাহর ভয়ে পানাহার ও অন্যান্য বর্জনীয় বিষয় থেকে বিরত থাকে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা লাভের আশায় ইন্দ্রিয় স্বাদ-তৃপ্তি থেকে বিরত থাকেন রোজাদার। তাকওয়া অর্জন ও তাকওয়াভিত্তিক জীবন গঠনই সিয়াম সাধনার প্রধান উদ্দেশ্য। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মহান আল্লাহ তায়ালা তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্যেই রমজানের রোজাকে ফরজ বা আবশ্যকীয় করেছেন। অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে রোজার পদ্ধতি ও মর্যাদা ভিন্ন। স্বাভাবিক কারণেই নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত প্রদর্শিত হয়। কিন্তু রোজা কোনোরূপ প্রদর্শন ছাড়াই নীরবে-নিভৃতে পালন করা যায়। রোজার গোপনীয়তা সম্পূর্ণ ব্যক্তির ইচ্ছাধীন। এ জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রোজার জন্য বিশেষ প্রতিদানের ঘোষণা দিয়েছেন। হাদিসে কুদসিতে উল্লেখ আছে, ‘মহান আল্লাহ বলেন, আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার জন্য কিন্তু সিয়াম ব্যতিক্রম। কেননা সিয়াম বা রোজা আমার জন্য আর আমিই এর প্রতিদান দেবো’ (বুখারি ও মুসলিম)।
সততা ও ন্যায়পরায়ণতাসহ বিভিন্ন মানবীয় গুণাবলি বিকাশ এবং মানবজীবনের সার্বিক সফলতার জন্য আত্মসংযম-আত্মনিয়ন্ত্রণ একান্ত প্রয়োজন। সংযম,সাধনা ছাড়া মানবিকতার বিকাশ হয় না। এ ছাড়া বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব অর্জনের জন্যও নিজের প্রবৃত্তি ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। আর সিয়াম সাধনার মাধ্যমেই তা অর্জন সম্ভব হয়। ইমাম গাজ্জালী রহ: বলেছেন, ‘দৈহিক কৃচ্ছন্স ও সংযমের সাথে যখন অন্তরের সাধনা যুক্ত হয় তখনই আদর্শ সংযম চেতনার শ্রেষ্ঠতা প্রতিফলিত হয় রমজানের সিয়াম সাধনায়।’ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি রহ: বলেছেন, ‘পাশবিক বাসনার প্রাবল্য ফেরেশতাসুলভ চরিত্র অর্জনের পথে আন্তরায়, তাই এ উপকরণগুলোকে পরাভূত করে পাশবিক শক্তিকে আয়ত্তাধীন করাই এর আসল তাৎপর্য।’
সবর বা ধৈর্যশীলতা মানবজীবনের অপরিহার্য গুণ। ধৈর্যের মাধ্যমে জীবনের যেকোনো বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। সত্য-ন্যায়ের পথে চলতে হলে ধৈর্য ও ত্যাগের প্রয়োজন। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হলে সবর অপরিহার্য। মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধগুলো যথাযথভাবে পালন করতেও সবর বা ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। মূলত ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রসহ মানবজীবনের সামগ্রিক ক্ষেত্রে ধৈর্য বা সবরের বিশেষ প্রয়োজন। আর রমজান মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সারা দিন প্রচন্ড- ক্ষুধা-তৃষ্ণা সত্ত্বেও পানাহার বর্জন করে রাতে দীর্ঘ সময় তারাবির নামাজ আদায় এবং ভোররাতে সেহরি গ্রহণ ইত্যাদির মাধ্যমে রোজাদারের ধৈর্যের প্রশিক্ষণ হয়। যারা এ প্রশিক্ষণে কামিয়াব হন তাদের জন্য রয়েছে পরম কাঙ্ক্ষিত জান্নাত। এ জন্য রাসূল সা: বলেছেন, ‘রমজান মাস ধৈর্যের মাস আর ধৈর্যের বিনিময় হচ্ছে জান্নাতের পরম সুখ।’ রমজানের সিয়াম সাধনা এক অনন্য ধর্মীয় ও নৈতিক অনুশীলন। সিয়াম বলতে শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকা বোঝায় না বরং অন্যায়-অসত্য, পরনিন্দা-অশ্লীলতা ইত্যাদি পাপাচার থেকে আত্মাকে কলুষমুক্ত করা বোঝায়। রোজার পুণ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য পানাহার বর্জনের সাথে পাপাচার-অশ্লীলতা বর্জনও শর্ত। অন্যথায় রোজার মূল উদ্দেশ্য সাধনই ব্যর্থ। এ জন্য রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকতে না পারে তার পানাহার থেকে বিরত থাকার কোনো প্রয়োজন নেই’ (বুখারি)
আত্মিক ও নৈতিক উন্নতির পাশাপাশি দৈহিক উন্নতিতেও রোজার ভূমিকা লক্ষণীয়। দীর্ঘ সময় পানাহার বর্জনে পরিপাকতন্ত্র সতেজ হয় বলে চিকিৎসকদের অভিমত। পারস্পরিক সহানুভূতি-সহমর্মিতা ও সামাজিক সম্প্রীতি-ভাতৃত্ববোধসহ মানবিক গুণাবলি প্রতিষ্ঠিত করতে রোজার ভূমিকা অনন্য। ভোগবিলাসে অভ্যস্ত মানুষেরা রোজার মাধ্যমে ক্ষুধা-তৃষ্ণার ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারে। এতে দরিদ্র-নিরন্ন মানুষের প্রতি বিত্তশালীদের সহানুভূতি-সহমর্মিতাবোধ জাগ্রত হয় এবং সমাজে সাম্য-মৈত্রীর পরিবেশ গঠন করতে সহায়তা করে। রোজা মুসলিম সমাজে পবিত্র-পুণ্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। রোজার মাধ্যমে মানুষ ধাবিত হয় পুণ্যের দিকে এবং দূরে থাকার সুযোগ পায় অন্যায়-পাপাচার থেকে। কঠোর সংযম সাধনা-সৎচিন্তায় রোজাদারের মন পাপ-পঙ্কিলমুক্ত হয়ে পবিত্র হয়ে ওঠে। তাই রোজার মাসে সমাজের সর্বত্র সৌম্য-শান্ত পূত পবিত্রতা বিরাজ করে। আর গোটা সমাজ মহান আল্লাহ তায়ালার রহমতের ফল্গুধারায় অভিষিক্ত হয়ে ওঠে। হাদিসের ভাষায়, ‘রমজান মাসে আকাশের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। অপর দিকে দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়’ (বুখারি ও মুসলিম)।
রোজা মুসলিম সমাজের ঐতিহ্য-সমৃদ্ধির স্মারক। রোজার মাসেই বিশ্ববাসীর জন্য অবতীর্ণ হয়েছে পবিত্র মহাগ্রন্থ আল কুরআন। রোজার রাতেই লুকিয়ে আছে হাজার মাস থেকেও শ্রেষ্ঠ রাত ‘লাইলাতুল কদর’।
আর রোজার মাসেই বদর যুদ্ধে অল্প সংখ্যক মুসলিম সৈনিক বিজয়ী হয়েছিলেন প্রশিক্ষিত বিশাল কাফির কুরাইশ বাহিনীর বিরুদ্ধে। এ রকম অনেক সুখকর ঘটনা ঘটেছে মহিমান্বিত রমজান মাসে। প্রকৃতপক্ষে আধ্যাত্মিক-নৈতিক উন্নতি, পারস্পরিক সহানূভূতি-সহমর্মিতা, সামাজিক উন্নয়ন-সম্প্রীতি অর্জনের লক্ষ্যে রোজার কঠোর সংযম সাধনা এক অনন্য ইবাদত। তাই মুসলিম সমাজে রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক ও অসাধারণ। আসুন আমরা সবাই যথাযথভাবে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি, দুনিয়ার শান্তি ও পরকালীন মুক্তির পথ অন্বেষণ করি। আমিন!

Share this

Related Posts

Previous
Next Post »