প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাঃ), তাঁর বংশধর, সহচর ও তাঁর বন্ধুদের উপর। রামাযানের রোযা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন। আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
(يَأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمََنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قََبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ)
“হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম (রোযা) ফরজ করা হয়েছে যেমনভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা পরহেজগার হতে পার। (সূরা বাকারাঃ ১৮৩) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে পাঁচটি। ১) এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য মাবুদ নাই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহ্র রাসূল ২) নামায কায়েম করা ৩) যাকাত আদায় করা ৪) রামাযানের রোযা রাখা ৫) কাবা ঘরের হজ্জ পালন করা। (বুখারী ও মুসলিম)
সিয়ামের অর্থঃ
ইবাদতের নিয়তে ও ছাওয়াবের আশায় ফজর উদিত হওয়ার পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, যৌন সম্ভোগ এবং অন্যান্য নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার নাম ছিয়াম বা রোজা।
নিম্নে নবী (সাঃ) এর রোজা রাখার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি বর্ণিত হলো। এতে রয়েছে রোজার যাবতীয় আহকাম, ওয়াজিব ও আদব সমূহ। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা তিনি যেন মুসলমানদের ছোট-বড় প্রতিটি কাজে তাদের নবীর সুন্নাতের অনুসরণ করার তাওফীক দান করেন।
রোজার বিধানসমূহঃ
১) নিয়তঃ
ফরজ রোজার ক্ষেত্রে সুবহে সাদেকের পূর্বেই নিয়ত করতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের পূর্বে নিয়ত করবেনা, তার রোজা হবেনা। (আবু দাউদ) রাসূল (সাঃ) আরও বলেন, যে ব্যক্তি রাত্রিতে (ফজরের পূর্বে) নিয়ত করবেনা, তার রোজা বিশুদ্ধ হবেনা। (নাসাঈ)
নিয়তের স্থান হলো অন্তর। নবী (সাঃ) অথবা তাঁর কোন সাহাবী (রাঃ) থেকে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করার কথা প্রমাণিত নেই। তাই রোজাসহ যে কোন ইবাদতের শুরুতে মুখে নিয়ত পাঠ করা জঘন্যতম বিদআত।
২) রোজার সময়ঃ
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الخَيْطِ الأََسْوَدِ مِنَ الفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوْا الصِّيَامَ اِلَى الَّيْلِ
আর তোমরা খাও পান কর যে পর্যন্ত কালো সুতা থেকে সাদা সুতা প্রকাশিত না হয়। অর্থাৎ ফজরের শুভ্রতা সুস্পষ্ট না হয়। অতঃপর রোযাকে তোমরা রাত পর্যন্ত পূর্ণ কর।” (সূরা বাকারাঃ ১৮৭) যখন পূর্ব দিক থেকে রাত আগমন করবে এবং পশ্চিমাকাশে দিন লুকিয়ে যাবে ও সূর্য অস্তমিত হবে, তখনই রোজাদার ইফতার করবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যখন এই দিক থেকে (পূর্ব দিক থেকে) রাত আগমণ করবে এবং এই দিকে (পশ্চিম দিকে) দিন লোপ পাবে, তখন অবশ্যই রোজাদার ইফতার করে নিবে। (বুখারী ও মুসলিম)
৩) সাহুর খাওয়াঃ
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আমাদের ও আহলে কিতাবদের (ইয়াহুদী-খ্রীষ্টানদের) ছিয়ামের মাঝে পার্থক্য হলো সাহুর খাওয়া। (মুসলিম) ঈয়াহুদী ও খ্রীষ্টনরা রোজা রাখে। কিন্তু তারা সাহুর খায়না। এজন্য উম্মাতে মুহাম্মাদীদেরকে তাদের বিরোধিতা করে সাহুরী খেয়ে রোজা রাখতে বলা হয়েছে। অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “তোমরা সাহুর খাও। কারণ এতে বরকত রয়েছে।” (বুখারী ও মুসলিম) সাহুর খাওয়াতে বরকত থাকার বিষয়টি অতি সুস্পষ্ট। কারণ এতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাতের অনুসরণ করা হয় এবং সাহুর খাওয়াতে রোজাদার সারা দিন শক্তিশালী থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর সুন্নাত হলো ফজরের কিছু পূর্বে সাহুর খাওয়া। অর্থাৎ দেরীতে খাওয়া।
৪) যাদের জন্য রোজা ভঙ্গ করার অনুমতি আছেঃ
(ক) অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক-বালিকাদের উপর রোজা রাখা ফরজ নয়। তবে তাদেরকে অভ্যাস করানোর জন্য রোজার আদেশ দেয়া যেতে পারে।
(খ) রোগী যদি অসুখ সেড়ে যাওয়ার আশা রাখে, তবে তার জন্য রোজা ভঙ্গ করা যায়েজ আছে। পরে রোজা কাযা করতে হবে।
(গ) পাগলের উপর রোজা ফরজ নয়। তার উপর কাযা বা মিসকীনকে খাদ্য দান, কোনটিই জরুরী নয়।
(ঘ) অতি বৃদ্ধ অথবা সুস্থ হওয়ার আশা নাই, এমন রোগী ব্যক্তি রোযা রাখতে অক্ষম হলে, তাদের পক্ষ হতে প্রতিদিন একজন করে মিসকীনকে খাওয়াতে হবে।
(ঙ) গর্ভবতী ও স্তন্যদায়িনী মহিলা যদি রোজা রাখার কারণে তাদের শিশুদের বা নিজেদের স্বাস্থ্যের ক্ষতির আশঙ্কা করে, তাহলে তারা রোযা ভঙ্গ করতে পারবে। তবে তারা পরবর্তীতে সুবিধা মত সময়ে রোজা কাযা করে নিবে।
(চ) হায়েয (মাসিক) চলা কালে এবং সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর নিফাসের রক্ত প্রবাহমান থাকা অবস্থায় রোজা রাখা নিষেধ। তারা পরবর্তীতে সমান সংখ্যায় রোজা কাযা করে নিবে।
(ছ) পানিতে ডুবন্ত বা অগ্নিতে দগ্ধমান ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে গিয়ে রোজা ভঙ্গ করতে বাধ্য হলে পরবর্তীতে কাযা করে নিবে।
(জ) সফর (ভ্রমন) অবস্থায় রোজা ভাঙ্গা বা রাখা উভয়ই বৈধ। কষ্ট অনুভব হলে ভাঙ্গাই উত্তম। পরবর্তীতে অবশ্যই কাযা করতে হবে। এই অনুমতিতে সর্বদা ভ্রমনকারী আর বিশেষ প্রয়োজনে হঠাৎ ভ্রমনকারীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
৫) রোজাদারের জন্য যা বর্জনীয়ঃ
রোজা অবস্থায় যাবতীয় গুনাহ ও পাপের কাজ থেকে বিরত থাকা একান্ত জরুরী। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে রোজাদার মিথ্যা কথা এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে পারলনা, তাকে পানাহার থেকে বিরত রেখে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারী)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেন, শুধুমাত্র পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়। বরং প্রকৃত রোজা হলো পানাহারের সাথে সাথে অনর্থক ও পাপের কাজ থেকে সম্পুর্ণরূপে বিরত থাকা। রোজা থাকা অবস্থায় যদি তোমার সাথে কেউ ঝগড়ায় লিপ্ত হয়, তুমি তাকে বল আমি রোজাদার! আমি রোজাদার! আমার সাথে ঝগড়া করোনা। (সহীহ ইবনে খুযায়মা)
৬) রোজাদারের জন্য যা বৈধঃ
(ক) স্ত্রীর সাথে মিলন করার পর গোসল করে পবিত্র হওয়ার পূর্বে সকাল হয়ে যাওয়ার ভয় থাকলে অপবিত্র অবস্থায়ই সাহুরী খেয়ে রোজার নিয়ত করে নিতে পারবে। আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রামাযানের রাত্রিতে স্ত্রী সহবাসের পর গোসল করে পবিত্র হওয়ার আগেই কখনও কখনও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর সকাল (ফজর) হয়ে যেত। অতঃপর সকাল হয়ে যাওয়ার পর তিনি গোসল করতেন এবং রোজা রাখতেন। (বুখারী ও মুসলিম)
(খ) রোজা অবস্থায় মেসওয়াক করাতে কোন অসুবিধা নেই। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, আমি যদি আমার উম্মাতের উপর কঠিন না মনে করতাম, তাহলে প্রত্যেক অযুর পূর্বে মেসওয়াক করতে আদেশ দিতাম। (বুখারী ও মুসলিম) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্র হাদীসে রোজাদারকে পৃথক করেননি। যাতে বুঝা যাচ্ছে রোজাদারও প্রত্যেক নামাজ ও অযুর পূর্বে মেসওয়াক করতে পারবে। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার আগে মেসওয়াক করা যাবে, পরে করা যাবেনা এধরণের কথা বলা ঠিক নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রোজা থাকা অবস্থায় দিনের প্রথমভাগে ও শেষভাগে অর্থাৎ সব সময় মেসওয়াক করতেন।
(গ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রোজা অবস্থায় কুলি করতেন এবং নাকে পানি দিতেন। তবে রোজা অবস্থায় বেশী করে নাকে দিতে এবং গড়গড়া করে কুলি করতে নিষেধ করেছেন। (আবু দাউদ)
(ঘ) রোজা অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন করা ও তার শরীরের সাথে শরীর লাগানোতে রোজার কোন ক্ষতি হবেনা। আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রোজা অবস্থায় ¯ী¿দেরকে চুম্বন করতেন এবং তাদের সাথে বিনোদন করতেন। তবে তিনি আপন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রনে তোমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী ছিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)
যে সমস্ত যুবক নিজেদেরকে সামলাতে পারবেনা, তাদের জন্য রোজা অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন ও আলিঙ্গন করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
(ঙ) পানাহারের কাজ দেয়না, এমন ইনজেকশন নিলে অথবা পরীক্ষা করার জন্য রক্ত বের করলে রোজার কোন ক্ষতি হবেনা। তেমনিভাবে দাঁত উঠালে, অনিচ্ছাকৃতভাবে রোগের কারণে বমি আসলে রোজার কোন ক্ষতি হবেনা।
(চ) মহিলাগণ রান্না করার সময় তরকারীর লবন ও বিভিন্ন অবস্থা পরীক্ষা করার জন্য জিহবা দ্বারা তরকারীর স্বাদ নিলে রোজার কোন ক্ষতি হবেনা।
(ছ) চোখে ড্রপ ব্যবহার করলে এবং নাকের ছিদ্র দিয়ে ঔষধ প্রবেশ করালেও রোজা নষ্ট হবেনা। এমনিভাবে শরীরের যে কোন অংশ দিয়ে ঔষধ প্রবেশ করানোতে কোন অসুবিধা নেই। তবে শর্ত হচ্ছে যে ঔষধ যেন পানাহারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার না হয়।
(জ) প্রচন্ড গরমের দিনে শরীরে পানি ঢালা, বেশী বেশী গোসল করায় কোন অসুবিধা নেই।
(ঝ) ভুলবশতঃ পানহার করে ফেললেও রোজা নষ্ট হবেনা। তবে মনে হওয়ার সাথে সাথে পানাহার বন্ধ করে দিতে হবে এবং দিনের বাকী অংশ না খেয়ে থাকতে হবে। এ অবস্থায় রোজা বিশুদ্ধ হবে। কাযা বা কাফ্ফারা কোনটিই ওয়াজিব হবেনা।
৭) ইফতারের সময় করণীয়ঃ
(ক) সূর্য ডুবার সাথে সাথে বিলম্ব না করে ইফতার করা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাত। দেরীতে ইফতার করা ইয়াহুদী-খ্রীষ্টানদের অভ্যাস। তারা আকাশের তারকা প্রকাশিত হওয়ার জন্য বসে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। তাই মুসলমানদেরকে তাদের বিরোধিতা করে সূর্য অস্ত যাওয়ার পর পরই ইফতার করতে আদেশ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “মানুষ ততদিন কল্যাণের ভিতর থাকবে, যত দিন তাড়াতাড়ি ইফতার করবে।” (বুখারী) আমাদের দেশে সাবধানতার জন্য দু’তিন মিনিট দেরী করে ইফতার করা হয়ে থাকে। যা প্রিয় নবী (সাঃ)এর সুন্নাতের সুস্পষ্ট বিরোধিতার শামিল।
(খ) মাগরিবের নামাযের পূর্বে ইফতার করা সুন্নাত। আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাগরিবের নামাযের পূর্বে ইফতার করতেন। (আবু দাউদ)
(গ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর সুন্নাত ছিল খেজুর দিয়ে ইফতার করা। আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাগরিবের নামায পড়ার আগে কয়েকটি রুতাব (পাকা খেজুর) দিয়ে ইফতার করতেন। পাকা খেজুর না থাকলে ইফতারের সময় শুকনা খেজুর খেতেন। আর তা না থাকলে সামান্য পানি দিয়ে ইফতার করতেন। (আবু দাউদ)
(ঘ) ইফতারের সময় রোজাদারের দু’আ কবুল হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ইফতারের সময় রোজাদারের দু’আ ফেরত দেওয়া হয়না। (ইবনে মাজাহ) ইফতারের সময় নির্দিষ্ট কোন দু‘আ নেই। রোজাদার ইচ্ছামত দু’আ করবে। তবে ইফতার করার সময় শুধু বিসমিল্লাহ বলবে। ইফতার শেষ করে এই দু’আ পাঠ করবেঃ (ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابَتلَّتِ العُرُوْقُ وَ ثَبَتَ الأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللّه) উচ্চারণ: জাহাবাজ্ জমাউ ওয়াব্তাল্লাতিল উরূকু ওয়া ছাবাতাল আযরু ইনশাআল্লাহ। অর্থঃ পিপাসা দূরীভুত হয়েছে, শিরাসমূহ শীতল হয়েছে, আল্লাহর ইচ্ছায় বিনিময়ও নির্ধারিত হবে। (আবু দাউদ)
৮) রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহঃ
(ক) রোজাদার ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। চাই সে খাদ্য বা পানীয় উপকারী হোক বা না হোক। হালাল হোক বা হারাম হোক। তাই ধুমপান করলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। তবে ভুলবশতঃ কিছু খেয়ে নিলে অথবা জোর পূবর্ক রোজাদারকে কেহ কিছু খেতে বাধ্য করলে রোজার ক্ষতি হবেনা।
(খ) ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে রোজা নষ্ট হবে। তবে রোগের কারণে অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি আসলে রোজা ভঙ্গ হবেনা। যে ব্যক্তি রোগের কারণে অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি করবে, তার জন্য উক্ত রোজা কাযা করতে হবেনা। আর যে ব্যক্তি গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে ইচ্ছা করে বমি করবে, তার রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এবং সেই রোজা কাযা করতে হবে। (আবু দাউদ)
(গ) রোজাদার রামাযান মাসে দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাস করলে, তাকে উক্ত রোজা কাযা করতে হবে এবং কাফ্ফারা দিতে হবে। কাফ্ফারার পরিমাণ হলো একজন গোলাম আযাদ করা। তা করতে অক্ষম হলে একাধারে দু’মাস রোজা রাখতে হবে। এতেও অক্ষম হলে ষাট জন মিসকীনকে পেট ভরে খাওয়াতে হবে।
(ঘ) পানাহারের কাজ করে এমন ইনজেক্শন গ্রহণ করাতেও রোজা ভঙ্গ হবে।
(ঙ) মহিলাদের হায়েয বা নিফাস হলে অর্থাৎ মাসিক রক্তস্রাব শুরু হলে অথবা সন্তান প্রসব করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। পরবর্তীতে সমান সংখ্যক রোজা কাযা করে নিতে হবে।
(চ) হস্ত মৈথুন, আলিঙ্গন, অথবা চুম্বনের মাধ্যমে বির্যপাত ঘটালে রোজা ভঙ্গ হবে। তবে স্বপ্নদোষ, বা রোগের কারণে বির্যপাত হলে রোজা ভঙ্গ হবেনা। কেননা এতে রোজাদারের কোন ইচ্ছা ছিলনা।
(ছ) রক্ত বৃদ্ধিকারক ইনজেক্শন গ্রহণ করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। স্বাভাবিক দুর্বলতার কারণে যেসব ইনজেক্শন নেওয়া হয় অথবা যা খাদ্যের কাজ দেয়না, এমন ইনজেক্শন নেয়াতে রোজার কোন ক্ষতি হবেনা।
৯) বৈধ কারণে রোজা ভঙ্গ করলে কাযা করাঃ
বৈধ কোন কারণে রোজা ছুটে গেলে কালবিলম্ব না করে তা কাযা করে নিতে হবে। এতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরী নয়। পরবর্তী রামাযান আসার আগে যে কোন সময় আদায় করে নিলেই চলবে। কেউ রোজা রাখতে অক্ষম হলে তার জীবদ্দশায় তার পক্ষ থেকে রোজা রাখা যাবেনা। বরং প্রতিদিনের বিনিময়ে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করতে হবে। তবে কারও জিম্মায় রোজা আবশ্যক থাকা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে উত্তরাধিকারীগণ উক্ত রোজা পালন করবে। (বুখারী)
১০) বেনামাযীর রোজাঃ
যে ব্যক্তি রোজা রাখল অথচ নামায ছেড়ে দিল, সে তাওহীদের পর ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুকন ছেড়ে দিল। তার রোজা রাখাতে কোন লাভ হবেনা। কেননা নামায হলো দ্বীনের খুঁটি। বেনামাযী কাফের সমতুল্য। আর কাফেরের কোন আমলই গ্রহণযোগ্য নয়। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আমাদের মাঝে ও তাদের মাঝে চুক্তি হলো নামায। যে উহা পরিত্যাগ করবে, সে কাফের হয়ে যাবে। (আহমাদ)
১১) তারাবীর নামাযঃ
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রামাযানের রাত্রিতে জামাআতের সাথে কিয়াম করার নিয়ম চালু করেছিলেন। পরবর্তীতে ফরজ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি তা ছেড়ে দিয়েছেন। বিতরসহ এনামাযের রাকআত সংখ্যা এগার। আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, ‘রাসূল (সাঃ) রামাযান কিংবা অন্য মাসে রাতের নামায এগার রাকাতের বেশী পড়তেন না।’ (বুখারী ও মুসলিম)
আমীরুল মুমেনীন ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) উবাই বিন কাব ও তামীম দারী (রাঃ)কে ইমাম নিযুক্ত করে এগার রাকা’তই পড়ানোর আদেশ করেছিলেন। বিশ রাকা’তের পক্ষে যত দলীল পাওয়া যায়, তা সবই দুর্বল। সুতরাং সেদিকে কর্ণপাত করার কোন প্রয়োজন নেই। (দেখুন সালাতু তারাবীহ, আলবানী)
১২) রামাযানের শেষে ফিতরা আদায়ঃ
রামাযানের শেষে ফিতরা আদায় করা ফরজ। ইবনে ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রামাযান মাসে মানুষের উপর যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন। (বুখারী ও মুসলিম) ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, স্বাধীন-পরাধীন সকল মুসলমানের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব।
ফিতরার পরিমাণঃ
সাদাকাতুল ফিতরের পরিমাণ হচ্ছে দেশের প্রধান খাদ্য থেকে এক সা’ পরিমাণ খাদ্য দ্রব্য তথা বর্তমান হিসাবে প্রায় আড়াই কেজীর সমান। একদিন একরাত্রির খোরাকের অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী ব্যক্তির উপর ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। এক সা’ পরিমাণ ফিতরা আদায়ের দলীলের ক্ষেত্রে ইবনে ওমর (রাঃ) কতৃক বর্ণিত হাদীছটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ইবনে ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, স্বাধীন-কৃতদাস, ছোট-বড় সকলের উপর এক সা’ পরিমাণ ফিতরা ফরজ করেছেন। ঈদের নামাযের জন্য ঈদগাহে বের হওয়ার পূর্বে তা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন।” (বুখারী ও মুসলিম) ঈদের নামাযের পূর্বে ঈদের দিন সকাল বেলা ফিতরা আদায়ের উত্তম সময়। তবে ঈদের দু’একদিন পূর্বে আদায় করলেও চলবে।
আল্লাহর কাছে দু’আ করি তিনি যেন আমাদেরকে নবী (সাঃ) এর তরীকা অনুযায়ী রোজাসহ যাবতীয় ইবাদত সম্পন্ন করার তাওফীক দেন। আমীন॥
(يَأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمََنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قََبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ)
“হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম (রোযা) ফরজ করা হয়েছে যেমনভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা পরহেজগার হতে পার। (সূরা বাকারাঃ ১৮৩) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে পাঁচটি। ১) এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য মাবুদ নাই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহ্র রাসূল ২) নামায কায়েম করা ৩) যাকাত আদায় করা ৪) রামাযানের রোযা রাখা ৫) কাবা ঘরের হজ্জ পালন করা। (বুখারী ও মুসলিম)
সিয়ামের অর্থঃ
ইবাদতের নিয়তে ও ছাওয়াবের আশায় ফজর উদিত হওয়ার পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, যৌন সম্ভোগ এবং অন্যান্য নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার নাম ছিয়াম বা রোজা।
নিম্নে নবী (সাঃ) এর রোজা রাখার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি বর্ণিত হলো। এতে রয়েছে রোজার যাবতীয় আহকাম, ওয়াজিব ও আদব সমূহ। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা তিনি যেন মুসলমানদের ছোট-বড় প্রতিটি কাজে তাদের নবীর সুন্নাতের অনুসরণ করার তাওফীক দান করেন।
রোজার বিধানসমূহঃ
১) নিয়তঃ
ফরজ রোজার ক্ষেত্রে সুবহে সাদেকের পূর্বেই নিয়ত করতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের পূর্বে নিয়ত করবেনা, তার রোজা হবেনা। (আবু দাউদ) রাসূল (সাঃ) আরও বলেন, যে ব্যক্তি রাত্রিতে (ফজরের পূর্বে) নিয়ত করবেনা, তার রোজা বিশুদ্ধ হবেনা। (নাসাঈ)
নিয়তের স্থান হলো অন্তর। নবী (সাঃ) অথবা তাঁর কোন সাহাবী (রাঃ) থেকে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করার কথা প্রমাণিত নেই। তাই রোজাসহ যে কোন ইবাদতের শুরুতে মুখে নিয়ত পাঠ করা জঘন্যতম বিদআত।
২) রোজার সময়ঃ
আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ
وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الخَيْطِ الأََسْوَدِ مِنَ الفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوْا الصِّيَامَ اِلَى الَّيْلِ
আর তোমরা খাও পান কর যে পর্যন্ত কালো সুতা থেকে সাদা সুতা প্রকাশিত না হয়। অর্থাৎ ফজরের শুভ্রতা সুস্পষ্ট না হয়। অতঃপর রোযাকে তোমরা রাত পর্যন্ত পূর্ণ কর।” (সূরা বাকারাঃ ১৮৭) যখন পূর্ব দিক থেকে রাত আগমন করবে এবং পশ্চিমাকাশে দিন লুকিয়ে যাবে ও সূর্য অস্তমিত হবে, তখনই রোজাদার ইফতার করবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যখন এই দিক থেকে (পূর্ব দিক থেকে) রাত আগমণ করবে এবং এই দিকে (পশ্চিম দিকে) দিন লোপ পাবে, তখন অবশ্যই রোজাদার ইফতার করে নিবে। (বুখারী ও মুসলিম)
৩) সাহুর খাওয়াঃ
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আমাদের ও আহলে কিতাবদের (ইয়াহুদী-খ্রীষ্টানদের) ছিয়ামের মাঝে পার্থক্য হলো সাহুর খাওয়া। (মুসলিম) ঈয়াহুদী ও খ্রীষ্টনরা রোজা রাখে। কিন্তু তারা সাহুর খায়না। এজন্য উম্মাতে মুহাম্মাদীদেরকে তাদের বিরোধিতা করে সাহুরী খেয়ে রোজা রাখতে বলা হয়েছে। অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “তোমরা সাহুর খাও। কারণ এতে বরকত রয়েছে।” (বুখারী ও মুসলিম) সাহুর খাওয়াতে বরকত থাকার বিষয়টি অতি সুস্পষ্ট। কারণ এতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাতের অনুসরণ করা হয় এবং সাহুর খাওয়াতে রোজাদার সারা দিন শক্তিশালী থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর সুন্নাত হলো ফজরের কিছু পূর্বে সাহুর খাওয়া। অর্থাৎ দেরীতে খাওয়া।
৪) যাদের জন্য রোজা ভঙ্গ করার অনুমতি আছেঃ
(ক) অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক-বালিকাদের উপর রোজা রাখা ফরজ নয়। তবে তাদেরকে অভ্যাস করানোর জন্য রোজার আদেশ দেয়া যেতে পারে।
(খ) রোগী যদি অসুখ সেড়ে যাওয়ার আশা রাখে, তবে তার জন্য রোজা ভঙ্গ করা যায়েজ আছে। পরে রোজা কাযা করতে হবে।
(গ) পাগলের উপর রোজা ফরজ নয়। তার উপর কাযা বা মিসকীনকে খাদ্য দান, কোনটিই জরুরী নয়।
(ঘ) অতি বৃদ্ধ অথবা সুস্থ হওয়ার আশা নাই, এমন রোগী ব্যক্তি রোযা রাখতে অক্ষম হলে, তাদের পক্ষ হতে প্রতিদিন একজন করে মিসকীনকে খাওয়াতে হবে।
(ঙ) গর্ভবতী ও স্তন্যদায়িনী মহিলা যদি রোজা রাখার কারণে তাদের শিশুদের বা নিজেদের স্বাস্থ্যের ক্ষতির আশঙ্কা করে, তাহলে তারা রোযা ভঙ্গ করতে পারবে। তবে তারা পরবর্তীতে সুবিধা মত সময়ে রোজা কাযা করে নিবে।
(চ) হায়েয (মাসিক) চলা কালে এবং সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর নিফাসের রক্ত প্রবাহমান থাকা অবস্থায় রোজা রাখা নিষেধ। তারা পরবর্তীতে সমান সংখ্যায় রোজা কাযা করে নিবে।
(ছ) পানিতে ডুবন্ত বা অগ্নিতে দগ্ধমান ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে গিয়ে রোজা ভঙ্গ করতে বাধ্য হলে পরবর্তীতে কাযা করে নিবে।
(জ) সফর (ভ্রমন) অবস্থায় রোজা ভাঙ্গা বা রাখা উভয়ই বৈধ। কষ্ট অনুভব হলে ভাঙ্গাই উত্তম। পরবর্তীতে অবশ্যই কাযা করতে হবে। এই অনুমতিতে সর্বদা ভ্রমনকারী আর বিশেষ প্রয়োজনে হঠাৎ ভ্রমনকারীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
৫) রোজাদারের জন্য যা বর্জনীয়ঃ
রোজা অবস্থায় যাবতীয় গুনাহ ও পাপের কাজ থেকে বিরত থাকা একান্ত জরুরী। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে রোজাদার মিথ্যা কথা এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে পারলনা, তাকে পানাহার থেকে বিরত রেখে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারী)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেন, শুধুমাত্র পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়। বরং প্রকৃত রোজা হলো পানাহারের সাথে সাথে অনর্থক ও পাপের কাজ থেকে সম্পুর্ণরূপে বিরত থাকা। রোজা থাকা অবস্থায় যদি তোমার সাথে কেউ ঝগড়ায় লিপ্ত হয়, তুমি তাকে বল আমি রোজাদার! আমি রোজাদার! আমার সাথে ঝগড়া করোনা। (সহীহ ইবনে খুযায়মা)
৬) রোজাদারের জন্য যা বৈধঃ
(ক) স্ত্রীর সাথে মিলন করার পর গোসল করে পবিত্র হওয়ার পূর্বে সকাল হয়ে যাওয়ার ভয় থাকলে অপবিত্র অবস্থায়ই সাহুরী খেয়ে রোজার নিয়ত করে নিতে পারবে। আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রামাযানের রাত্রিতে স্ত্রী সহবাসের পর গোসল করে পবিত্র হওয়ার আগেই কখনও কখনও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর সকাল (ফজর) হয়ে যেত। অতঃপর সকাল হয়ে যাওয়ার পর তিনি গোসল করতেন এবং রোজা রাখতেন। (বুখারী ও মুসলিম)
(খ) রোজা অবস্থায় মেসওয়াক করাতে কোন অসুবিধা নেই। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, আমি যদি আমার উম্মাতের উপর কঠিন না মনে করতাম, তাহলে প্রত্যেক অযুর পূর্বে মেসওয়াক করতে আদেশ দিতাম। (বুখারী ও মুসলিম) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্র হাদীসে রোজাদারকে পৃথক করেননি। যাতে বুঝা যাচ্ছে রোজাদারও প্রত্যেক নামাজ ও অযুর পূর্বে মেসওয়াক করতে পারবে। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার আগে মেসওয়াক করা যাবে, পরে করা যাবেনা এধরণের কথা বলা ঠিক নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রোজা থাকা অবস্থায় দিনের প্রথমভাগে ও শেষভাগে অর্থাৎ সব সময় মেসওয়াক করতেন।
(গ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রোজা অবস্থায় কুলি করতেন এবং নাকে পানি দিতেন। তবে রোজা অবস্থায় বেশী করে নাকে দিতে এবং গড়গড়া করে কুলি করতে নিষেধ করেছেন। (আবু দাউদ)
(ঘ) রোজা অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন করা ও তার শরীরের সাথে শরীর লাগানোতে রোজার কোন ক্ষতি হবেনা। আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রোজা অবস্থায় ¯ী¿দেরকে চুম্বন করতেন এবং তাদের সাথে বিনোদন করতেন। তবে তিনি আপন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রনে তোমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী ছিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)
যে সমস্ত যুবক নিজেদেরকে সামলাতে পারবেনা, তাদের জন্য রোজা অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন ও আলিঙ্গন করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
(ঙ) পানাহারের কাজ দেয়না, এমন ইনজেকশন নিলে অথবা পরীক্ষা করার জন্য রক্ত বের করলে রোজার কোন ক্ষতি হবেনা। তেমনিভাবে দাঁত উঠালে, অনিচ্ছাকৃতভাবে রোগের কারণে বমি আসলে রোজার কোন ক্ষতি হবেনা।
(চ) মহিলাগণ রান্না করার সময় তরকারীর লবন ও বিভিন্ন অবস্থা পরীক্ষা করার জন্য জিহবা দ্বারা তরকারীর স্বাদ নিলে রোজার কোন ক্ষতি হবেনা।
(ছ) চোখে ড্রপ ব্যবহার করলে এবং নাকের ছিদ্র দিয়ে ঔষধ প্রবেশ করালেও রোজা নষ্ট হবেনা। এমনিভাবে শরীরের যে কোন অংশ দিয়ে ঔষধ প্রবেশ করানোতে কোন অসুবিধা নেই। তবে শর্ত হচ্ছে যে ঔষধ যেন পানাহারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার না হয়।
(জ) প্রচন্ড গরমের দিনে শরীরে পানি ঢালা, বেশী বেশী গোসল করায় কোন অসুবিধা নেই।
(ঝ) ভুলবশতঃ পানহার করে ফেললেও রোজা নষ্ট হবেনা। তবে মনে হওয়ার সাথে সাথে পানাহার বন্ধ করে দিতে হবে এবং দিনের বাকী অংশ না খেয়ে থাকতে হবে। এ অবস্থায় রোজা বিশুদ্ধ হবে। কাযা বা কাফ্ফারা কোনটিই ওয়াজিব হবেনা।
৭) ইফতারের সময় করণীয়ঃ
(ক) সূর্য ডুবার সাথে সাথে বিলম্ব না করে ইফতার করা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাত। দেরীতে ইফতার করা ইয়াহুদী-খ্রীষ্টানদের অভ্যাস। তারা আকাশের তারকা প্রকাশিত হওয়ার জন্য বসে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। তাই মুসলমানদেরকে তাদের বিরোধিতা করে সূর্য অস্ত যাওয়ার পর পরই ইফতার করতে আদেশ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “মানুষ ততদিন কল্যাণের ভিতর থাকবে, যত দিন তাড়াতাড়ি ইফতার করবে।” (বুখারী) আমাদের দেশে সাবধানতার জন্য দু’তিন মিনিট দেরী করে ইফতার করা হয়ে থাকে। যা প্রিয় নবী (সাঃ)এর সুন্নাতের সুস্পষ্ট বিরোধিতার শামিল।
(খ) মাগরিবের নামাযের পূর্বে ইফতার করা সুন্নাত। আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাগরিবের নামাযের পূর্বে ইফতার করতেন। (আবু দাউদ)
(গ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর সুন্নাত ছিল খেজুর দিয়ে ইফতার করা। আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাগরিবের নামায পড়ার আগে কয়েকটি রুতাব (পাকা খেজুর) দিয়ে ইফতার করতেন। পাকা খেজুর না থাকলে ইফতারের সময় শুকনা খেজুর খেতেন। আর তা না থাকলে সামান্য পানি দিয়ে ইফতার করতেন। (আবু দাউদ)
(ঘ) ইফতারের সময় রোজাদারের দু’আ কবুল হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ইফতারের সময় রোজাদারের দু’আ ফেরত দেওয়া হয়না। (ইবনে মাজাহ) ইফতারের সময় নির্দিষ্ট কোন দু‘আ নেই। রোজাদার ইচ্ছামত দু’আ করবে। তবে ইফতার করার সময় শুধু বিসমিল্লাহ বলবে। ইফতার শেষ করে এই দু’আ পাঠ করবেঃ (ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابَتلَّتِ العُرُوْقُ وَ ثَبَتَ الأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللّه) উচ্চারণ: জাহাবাজ্ জমাউ ওয়াব্তাল্লাতিল উরূকু ওয়া ছাবাতাল আযরু ইনশাআল্লাহ। অর্থঃ পিপাসা দূরীভুত হয়েছে, শিরাসমূহ শীতল হয়েছে, আল্লাহর ইচ্ছায় বিনিময়ও নির্ধারিত হবে। (আবু দাউদ)
৮) রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহঃ
(ক) রোজাদার ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। চাই সে খাদ্য বা পানীয় উপকারী হোক বা না হোক। হালাল হোক বা হারাম হোক। তাই ধুমপান করলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। তবে ভুলবশতঃ কিছু খেয়ে নিলে অথবা জোর পূবর্ক রোজাদারকে কেহ কিছু খেতে বাধ্য করলে রোজার ক্ষতি হবেনা।
(খ) ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে রোজা নষ্ট হবে। তবে রোগের কারণে অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি আসলে রোজা ভঙ্গ হবেনা। যে ব্যক্তি রোগের কারণে অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি করবে, তার জন্য উক্ত রোজা কাযা করতে হবেনা। আর যে ব্যক্তি গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে ইচ্ছা করে বমি করবে, তার রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এবং সেই রোজা কাযা করতে হবে। (আবু দাউদ)
(গ) রোজাদার রামাযান মাসে দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাস করলে, তাকে উক্ত রোজা কাযা করতে হবে এবং কাফ্ফারা দিতে হবে। কাফ্ফারার পরিমাণ হলো একজন গোলাম আযাদ করা। তা করতে অক্ষম হলে একাধারে দু’মাস রোজা রাখতে হবে। এতেও অক্ষম হলে ষাট জন মিসকীনকে পেট ভরে খাওয়াতে হবে।
(ঘ) পানাহারের কাজ করে এমন ইনজেক্শন গ্রহণ করাতেও রোজা ভঙ্গ হবে।
(ঙ) মহিলাদের হায়েয বা নিফাস হলে অর্থাৎ মাসিক রক্তস্রাব শুরু হলে অথবা সন্তান প্রসব করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। পরবর্তীতে সমান সংখ্যক রোজা কাযা করে নিতে হবে।
(চ) হস্ত মৈথুন, আলিঙ্গন, অথবা চুম্বনের মাধ্যমে বির্যপাত ঘটালে রোজা ভঙ্গ হবে। তবে স্বপ্নদোষ, বা রোগের কারণে বির্যপাত হলে রোজা ভঙ্গ হবেনা। কেননা এতে রোজাদারের কোন ইচ্ছা ছিলনা।
(ছ) রক্ত বৃদ্ধিকারক ইনজেক্শন গ্রহণ করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। স্বাভাবিক দুর্বলতার কারণে যেসব ইনজেক্শন নেওয়া হয় অথবা যা খাদ্যের কাজ দেয়না, এমন ইনজেক্শন নেয়াতে রোজার কোন ক্ষতি হবেনা।
৯) বৈধ কারণে রোজা ভঙ্গ করলে কাযা করাঃ
বৈধ কোন কারণে রোজা ছুটে গেলে কালবিলম্ব না করে তা কাযা করে নিতে হবে। এতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরী নয়। পরবর্তী রামাযান আসার আগে যে কোন সময় আদায় করে নিলেই চলবে। কেউ রোজা রাখতে অক্ষম হলে তার জীবদ্দশায় তার পক্ষ থেকে রোজা রাখা যাবেনা। বরং প্রতিদিনের বিনিময়ে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করতে হবে। তবে কারও জিম্মায় রোজা আবশ্যক থাকা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে উত্তরাধিকারীগণ উক্ত রোজা পালন করবে। (বুখারী)
১০) বেনামাযীর রোজাঃ
যে ব্যক্তি রোজা রাখল অথচ নামায ছেড়ে দিল, সে তাওহীদের পর ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুকন ছেড়ে দিল। তার রোজা রাখাতে কোন লাভ হবেনা। কেননা নামায হলো দ্বীনের খুঁটি। বেনামাযী কাফের সমতুল্য। আর কাফেরের কোন আমলই গ্রহণযোগ্য নয়। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আমাদের মাঝে ও তাদের মাঝে চুক্তি হলো নামায। যে উহা পরিত্যাগ করবে, সে কাফের হয়ে যাবে। (আহমাদ)
১১) তারাবীর নামাযঃ
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রামাযানের রাত্রিতে জামাআতের সাথে কিয়াম করার নিয়ম চালু করেছিলেন। পরবর্তীতে ফরজ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি তা ছেড়ে দিয়েছেন। বিতরসহ এনামাযের রাকআত সংখ্যা এগার। আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, ‘রাসূল (সাঃ) রামাযান কিংবা অন্য মাসে রাতের নামায এগার রাকাতের বেশী পড়তেন না।’ (বুখারী ও মুসলিম)
আমীরুল মুমেনীন ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) উবাই বিন কাব ও তামীম দারী (রাঃ)কে ইমাম নিযুক্ত করে এগার রাকা’তই পড়ানোর আদেশ করেছিলেন। বিশ রাকা’তের পক্ষে যত দলীল পাওয়া যায়, তা সবই দুর্বল। সুতরাং সেদিকে কর্ণপাত করার কোন প্রয়োজন নেই। (দেখুন সালাতু তারাবীহ, আলবানী)
১২) রামাযানের শেষে ফিতরা আদায়ঃ
রামাযানের শেষে ফিতরা আদায় করা ফরজ। ইবনে ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রামাযান মাসে মানুষের উপর যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন। (বুখারী ও মুসলিম) ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, স্বাধীন-পরাধীন সকল মুসলমানের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব।
ফিতরার পরিমাণঃ
সাদাকাতুল ফিতরের পরিমাণ হচ্ছে দেশের প্রধান খাদ্য থেকে এক সা’ পরিমাণ খাদ্য দ্রব্য তথা বর্তমান হিসাবে প্রায় আড়াই কেজীর সমান। একদিন একরাত্রির খোরাকের অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী ব্যক্তির উপর ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। এক সা’ পরিমাণ ফিতরা আদায়ের দলীলের ক্ষেত্রে ইবনে ওমর (রাঃ) কতৃক বর্ণিত হাদীছটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ইবনে ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, স্বাধীন-কৃতদাস, ছোট-বড় সকলের উপর এক সা’ পরিমাণ ফিতরা ফরজ করেছেন। ঈদের নামাযের জন্য ঈদগাহে বের হওয়ার পূর্বে তা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন।” (বুখারী ও মুসলিম) ঈদের নামাযের পূর্বে ঈদের দিন সকাল বেলা ফিতরা আদায়ের উত্তম সময়। তবে ঈদের দু’একদিন পূর্বে আদায় করলেও চলবে।
আল্লাহর কাছে দু’আ করি তিনি যেন আমাদেরকে নবী (সাঃ) এর তরীকা অনুযায়ী রোজাসহ যাবতীয় ইবাদত সম্পন্ন করার তাওফীক দেন। আমীন॥
অনুবাদ ও ব্যাখ্যাঃ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী