হাদীস লিপিবদ্ধকরণ কখন থেকে এবং বিভিন্ন ইমামগণের নির্দেশ

হাদীসশাস্ত্রের বিশ্বস্ততা ও প্রামাণিকতাকে খর্ব করার জন্য ইদানিং আমাদের সমাজের একদল লোক বলে-

হাদীসশাস্ত্রের যে বিপুল ভান্ডার বরেণ্য মুহাদ্দিসগণের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমাদের হস্তগত হয়েছে, তার সবগুলোই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে রাসুল (সাঃ) এর অন্তরধানের একশত বছর পর ।

সত্যিই কি হাদীস রাসুল (সাঃ) এর অন্তর্ধানের একশত বছর পর লিপিবদ্ধ হয়েছে ?
না হাদীস লিপিবদ্ধ করার চর্চা স্বয়ং রাসুল (সাঃ) এর জীবদ্দশাতেই বিদ্যমান ছিল ?

হাদীসশাস্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রাসুল (সাঃ) এর জীবদ্দশাতেই লিপিবদ্ধ হয়েছিল এবং এ সম্বন্ধে এত বেশী প্রমান মওজুদ রয়েছে যে, তা দেখে Sprenger ও Goldziher প্রমুখ পাশ্চাত্যের হাদীসশাস্ত্র বিশারদগণও একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে,

“হাদীস স্বয়ং রাসুল (সাঃ) এর জীবদ্দশাতেই লিপিবদ্ধ হয়েছিল” । Goldziher তাঁর Muhammedanische studian নামক গ্রন্থে অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণাদির দ্বারা এ দাবী সপ্রমাণিত করেছেন ।

আরবী শব্দ ‘‘কিতাবাতুল হাদীস’’ এর অর্থ হল ‘লিপিবদ্ধ করা’ ও “তদ্‌ভীনুল হাদীস’’ এর অর্থ হল ‘সংকলন করা’ ।

আমরা স্বীকার করি যে, হাদীস সংকলনের কাজ রাসুল (সাঃ) এর যুগে হয়নি বরং তা সাহাবাগণের শেষ যুগে আরম্ভ হয়েছিল ।

কিন্তু হাদীস “সংকলন করা” আর হাদীস “লিপিবদ্ধ করা” দু’টো এক জিনিস নয় । এ দু’টোর মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান ।

হাদীস রাসুল (সাঃ) এর যুগেই লিপিবদ্ধ হয়েছিল । নিম্নে কিছু প্রমান পত্র সুত্র সহ উল্লেখ করা হল-

(ক) হাদীসশাস্ত্রের বর্তমান গ্রন্থরাজি একটু মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করলে এ কথা দিবালোকের ন্যায় প্রতিভাত হয় যে,

প্রথিতযশা সাহাবাগণের অধিকাংশের নিকট এক একখানি “সহিফা” (বই) ছিল, যার মধ্যে তারা রাসুল (সাঃ) এর নিকট থেকে শ্রুত হাদীসগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখতেন ।

রাসুল (সাঃ) এর বিশিষ্ট সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আল-আস’ এর নিকট একখানা “সহিফা” ছিল যার মধ্যে তিনি নবী (সাঃ) এর সমস্ত “কওল” “আমল” লিপিবদ্ধ করে রাখতেন ।(বুখারী-কিতাবুল ইল্‌ম; তিরমি্যী-বাবুল ইল্‌ম; মুসনাদ আহমাদ বিন হাম্বল-২য় খন্ড পৃঃ ১৬৪, ২০৭, ২১৫, ২৪৮; তাবাকাত ইবনে সা’আদ ৪র্থ খন্ড ২য় ভাগ পৃঃ ৭)

আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস এর গ্রন্থখানার নাম ছিল “সাদিকা” । বিখ্যাত তাফসীরকার তাবি’ঈ মুজাহিদ এ গ্রন্থখানি ইবনে আমর বিন আস এর নিকট স্বচক্ষে দেখেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন (উসদুল গাবা, তাবাকাত ইবনে সা’আদ ৪র্থ খন্ড ২য় ভাগ পৃঃ ৮)

আব্দুল্লাহ বিন আমরের মৃত্যুর পর এ গ্রন্থখানি উত্তরাধিকার সূত্রে তদীয় পৌত্র ‘আব্দুল্লাহর হস্তগত হয় এবং তিনি তার সদ্ব্যবহার করেন (Gold, muh, stu ২য় খন্ড পৃঃ ৫)

হাদীস বর্ণনায় ক্ষেত্রে সংখ্যার দিক দিয়ে সর্বোচ্চ স্থান লাভ করেছেন আবূ হুরায়রাহ (রাযিঃ) । তার মাধ্যমে সর্বাধিক সংখ্যক হাদীস হস্তগত হয়েছে । তার বর্ণিত হাদীসগুলোর সংখ্যা ৫৩৭৪ (মিফতাহুস সুন্নাহ্‌ পৃঃ ২৭)

আবু হুরায়রাহ (রাযিঃ) প্রায়শঃ এ কথা বলতেন যে, যদি আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস হাদীস লিপিবদ্ধ করে না রাখতেন তবে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হাদীস বর্ণনাকারীর পদ অধিকার করতে পারতাম (বুখারী-কিতাবুল ইল্‌ম; তিরমি্যী-বাবুল ইল্‌ম;)

(খ) রাসুল (সাঃ) এর শেষ্ঠ সাহাবী এবং ইসলাম জগতের প্রথম খলিফা আবূ বাক্‌র (রাযিঃ) এর নিকট ৫০০ হাদীস সম্বলিত একখানি “সহীফা” ছিল (তাবাকাতুল হুফ্‌ফায ২য় খন্ড পৃঃ ৫)

(গ) আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাযিঃ) এর নিকট একাধিক “সহীফা” ছিল । ইবনে আব্দুল বার লিখেছেন যে, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের নিকট “এক উটের বোঝা” পরিমাণ লিখিত গ্রন্থ মওজুদ ছিল (Journal Asiatik Society of bengal Vol 25 p. 380)

(ঘ) আবূ হুরায়রাহ (রাযিঃ) তার জীবন সায়াহ্নে কতগুলো হাদীস লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং এসব লিখিত হাদীস ইবনে ওয়াহ্‌হাব ও উমাইয়াহ্‌ যামরীকে দেখিয়েছিলেন (জামিউল বয়ান ১ম ভাগ পৃঃ ৭৪)

আবু হুরায়রাহ (রাযিঃ) এর বর্ণিত হাদীসগুলো যে গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে তা “সহীফা” ইবনে হুমাম নামে পরিচিত (তাহযীবুত তাহযীব ১ম খন্ড ক্রমিক নম্বর ৫৭৫; মুসনাদ আহমাদ বিন হাম্বল ২য় খন্ড পৃঃ ৩১২-৩১৮)

রাসুল (সাঃ) স্বয়ং কতগুলো সাহাবাকে হাদীস লিখিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন

(ক) তাহযীবুত্‌ তাহযীব নামক গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে যে, আবু রাফি (রাঃ) নামক জনৈক সাহাবী রাসুল (সাঃ) এর নিকট হতে হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখার অনুমতি গ্রহণ করেছিলেন (তাহযীবুত্‌ তাহযীব ৩য় খন্ড পৃঃ ৪৪০)

(খ) এ কথা সর্বজনবিদিত যে, রাসুল (সাঃ) শুধুমাত্র একজন বনীই ছিলেন না বরং তিনি একাধারে নবী ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন । রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য তাঁকে অনেক সময় প্রাদেশিক গভর্নরগণের নিকট লিখিত ফরমান জারী করতে হত ।

“কানযুল উম্মাল” নামক হাদীস গ্রন্থে রাসুল (সাঃ) এর এরূপ একখানি সুদীর্ঘ ফরমানের হুবহু নকল (True copy) আমরা দেখতে পাই । এ ফরমানখানি ইয়ামানের তদানীন্তন গভর্নর আমর বিন আল আস এর নিকট প্রেরিত হয়েছিল । এতে নামায, রোযা, সাদাকাহ্‌-যাকাত, দিয়াত (Compensation of murder) আকীদাহ্‌ ইত্যাদি বহু মাসআলা-মাসায়িলের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় (কানযুল উম্মাল ৩য় খন্ড পৃঃ ১৮৬-১৮৭)

এ সম্বন্ধে Dr. Sprenger তার Life of Muhammet নামক পুস্তকে লিখেছেন-

“সাধারণতঃ এ বিশ্বাস পোষণ করা হয় যে, হিজরী সনের প্রথম শতাব্দীতে হাদীস সংরক্ষণের একমাত্র ব্যবস্থা ছিল তা মুখস্থ রাখা ।

ইউরোপের সত্যানুসন্ধিৎসু ব্যক্তিগণ ভুলবশতঃ এ ধারণা পোষণ করেন যে, বুখারীতে যেসব হাদীস উল্লিখিত হয়েছে তা ইমাম বুখারীর পূর্বে আর কেউ লিপিবদ্ধ করেনি ।

এ ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা ।

আব্দুল্লাহ বিন আমর এবং অন্যান্য সাহাবাগণ হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখতেন” (Life of muhd 66-67)

Goldziher লিখেছেনঃ হাদীস শাস্ত্রের ‘মতন’ শব্দটি যা ‘ইসনাদ’ এর প্রতিকুল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এ ভুল ধারণা নিরসনের জন্য যথেষ্ট যে, মুসলিমগণ তাকে (হাদীসকে) লিপিবদ্ধ করে রাখা অবৈধ মনে করতেন
এবং তারা তাকে শুধু মুখস্থই করে রাখতেন ।

এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখা তার সংরক্ষণের একটি অতি প্রাচীনতম পন্থা (Muh, Stu. Vol. ii, p. 8-9)

আল্লাহ বলেন, “রাসুলের আহবানকে তোমরা তোমাদের একে অপরের প্রতি আহবানের মতো গণ্য করো না; তোমাদের মধ্যে যারা অলক্ষ্যে সরে পড়ে আল্লাহ তো তাদেরকে জানেন । সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের উপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি” (সুরা নূর আয়াত ৬৩)

“যারা (সব) কথা শুনে, অতঃপর উত্তমগুলো আমল করে, তারাই হলো হেদায়াতপ্রাপ্ত, আর তারাই হলো বুদ্ধিমান’’ । (সূরা আয যুমারঃ আয়াত ১৮)

“জাযাকাল্লাহু খায়রান । আমীণ”

Share this

Related Posts

Previous
Next Post »