হজ্জের পরে হাজীদের করণীয়!

যে কোন সৎআমল করার পর আমাদের নিকট যে বিষয়টি মূখ্য হয়ে দাঁড়ায় তা হলো: আমল কবূলের বিষয়; কবূল হলো কি হলো না।
নিশ্চয়ই সৎআমল করতে পারা বড় একটি নেয়ামত; কিন্তু অন্য একটি নেয়ামত ব্যতীত তা পূর্ণ হয় না, যা তার চেয়ে বড়, তা হলো কবূলের নিয়ামত। এটি নিশ্চিত যে হজের পর এত কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে তা যদি কবূল না হয়, তবে অবশ্যই এক মহা বিপদ। এর চেয়ে আর বড় ক্ষতি কি রয়েছে যদি আমলটি প্রত্যাখ্যাত হয়। আর দুনিয়া আখেরাতের স্পষ্ট ক্ষতিতে প্রত্যাবর্তন করে?
বান্দা যেহেতু জানে, অনেক আমলই রয়েছে যা বিভিন্ন কারণে গ্রহণযোগ্য হয় না। অতএব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমল কবূলের কারণ ও উপায় সম্পর্কে জানা। যদি কারণগুলি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তবে যেন আল্লাহর প্রশংসা করে এবং ক্রমাগত তার উপর অটল থাকে ও আমল করে যায়। আর যদি তা বিদ্যমান না পায় তবে এ মুহূর্তেই যে বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো: ইখলাসের সাথে সেগুলোর মাধ্যমে আমল করায় সচেষ্ট হওয়া।
কতিপয় আমল কবূলের কারণ ও উপায়
১। স্বীয় আমলকে বড় মনে না করা ও তার উপর গর্ব না করাঃ মানুষ যতই আমলই করুক না কেন, আল্লাহ তার দেহ থেকে শুরু করে সার্বিকভাবে যত নেয়ামত তাকে প্রদান করেছেন, সে তুলনায় মূলতঃ সে আল্লাহর কিছুই হক আদায় করতে পারেনি। সুতরাং একনিষ্ট ও খাঁটি মু’মিনের চরিত্র হলো, তারা তাদের আমলসমূহকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে, বড় মনে করে গর্ব-অহংকার করবে না; যার ফলে তাদের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায় ও সৎ আমল করার ক্ষেত্রে অলসতা এসে যায়।
স্বীয় আমলকে তু্‌চ্ছ জ্ঞান করার সহায়ক বিষয়ঃ (১) আল্লাহ তায়ালাকে যথাযথভাবে জানা ও চেনা (২) তাঁর নিয়ামতসমূহ উপলব্ধি করা ও (৩) নিজের গুনাহ-খাতা ও অসম্পূর্ণতাকে স্মরণ করা। যেমনঃ আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে গুরু দায়িত্ব অর্পণের পরে অসীয়ত করেনঃ
অর্থ: “(নবুয়্যতের বোঝা বহন করত:) তুমি (তোমার রবের প্রতি) অনুগ্রহ প্রকাশ কর না যার ফলে বেশি কিছু আশা করবে”। (সূরা মুদ্দাসসির: ৬)
২। আমলটি কবূল হবে কিনা, এমর্মে অশঙ্কিত থাকাঃসালাফে সালেহীন, সাহাবায়ে কিরাম আমল কবূল হওয়ার ব্যাপারটিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন, এমনকি তাঁরা ভয় ও আশঙ্কায় থাকতেন। যেমনঃ আল্লাহ তাঁদের অবস্থা বর্ণনা করে বলেনঃ
অর্থ: “যারা ভীতকম্পিত হয়ে দান করে যা দান করার কেননা তারা তাদের রবের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে”। (মুমিনুন: ৬০)
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আয়াতের ব্যাখ্যা করেন যে, তারা রোযা রাখে, নামায আদায় করে, দান-খয়রাত করে আর ভয় করে যে, মনে হয় তা কবূল হয় না।
আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেনঃ তোমাদের পক্ষ হতে তোমাদের আমল সমূহ কবূল হওয়ার ব্যাপারে তোমরা খুব বেশি গুরুত্ব প্রদান কর। তোমরা কি আল্লাহর বাণী শ্রবণ কর না-
অর্থ: “নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের পক্ষ হতেই কবূল করে থাকেন”। (সূরা: মায়েদাঃ ২৭)
৩। আমল কবূলের আশা পোষণ ও দু’আ করাঃ আল্লাহর প্রতি ভয়ই যথেষ্ট নয় ; বরং অনুরূপ তাঁর নিকট আশা পোষণ করতে হবে। কেননা আশা বিহীন ভয় নিরাশ হওয়ার কারণ এবং ভয় বিহীন আশা আল্লাহর শাস্তি হতে নিজেকে মুক্ত মনে করার কারণ; অথচ উভয়টিই দোষনীয়, যা মানুষের আকীদা ও আমলে মন্দ প্রভাব বিস্তার করে। জেনে রাখুন! আমল প্রত্যাখ্যান হয়ে যাওয়ার ভয়-আশঙ্কার সাথে সাথে আমল কবূলের আশা পোষণ মানুষের জন্যে বিনয়-নম্রতা ও আল্লাহ ভীতি এনে দেয়। যার ফলে তার ঈমান বৃদ্ধি পায়। যখন বান্দার মধ্যে আশা পোষণের গুণ সাব্যস্ত হয় তখন সে অবশ্যই তার আমল কবূল হওয়ার জন্য তার প্রভূর নিকট দু’হাত তুলে প্রার্থনা করে। যেমন- করেছিলেন আমাদের পিতা ইবরাহীম খলীল ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম)। যা আল্লাহ তায়ালা তাদের কা’বা গৃহ নির্মাণের ব্যাপারটি উল্লেখ করে বর্ণনা করেন।
অর্থ: “যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম) বায়তুল্লাহর ভিত্তি বুলন্দ করেন (দু’আ করেন) হে আল্লাহ আমাদের প্রতিপালক তুমি আমাদের দু’আ কবূল করে নিও। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ”। (সূরা বাকারা: ১২৭
৪। বেশি বেশি ইস্তেগফার-ক্ষমা প্রার্থনাঃ মানুষ তার আমলকে যতই পরিপূর্ণ করার জন্য সচেষ্ট হোক না কেন, তাতে অবশ্যই ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা থেকেই যাবে। এজন্যেই আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে শিক্ষা দান করেছেন, কিভাবে আমরা সে অসম্পূর্ণতাকে দূর করবো। সুতরাং তিনি আমাদেরকে ইবাদত-আমলের পর ইস্তেগফার-ক্ষমা প্রার্থনার শিক্ষা দান করেন। যেমনঃ আল্লাহ তায়ালা হজের হুকুম বর্ণনার পর বলেনঃ
অর্থ: “অত:পর তোমরা (আরাফাত) হতে প্রত্যাবর্তন করে, এসো যেখান থেকে লোকেরা প্রত্যাবর্তন করে আসে। আর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাক, নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা ক্ষমাশীল ও দয়াবান।” (সূরা বাকারা: ১৯৯)
আর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রত্যেক নামাযের পর তিনবার করে “আস্তাগফিরুল্লাহ” (আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি) বলতেন।
৫। বেশি বেশি সৎ আমল করাঃ নিশ্চয়ই সৎআমল একটি উত্তম বৃক্ষ। বৃক্ষ চায় তার পরিচর্যা, যেন সে বৃদ্ধি লাভ করে সুদৃঢ় হয়ে যথাযথ ফল দিতে পারে। সৎআমলের পর সৎআমল করে যাওয়া অবশ্যই আমল কবূলের একটি অন্যতম আলামত। আর এটি আল্লাহর বড় অনুগ্রহ ও নেয়ামত, যা তিনি তার বান্দাকে প্রদান করে থাকেন। যদি বান্দা উত্তম আমল করে, ও তাতে ইখলাস বজায় রাখেন তখন আল্লাহ তার জন্য অন্যান্য উত্তম আমলের দরজা খুলে দেন। যার ফলে তার নৈকট্যেরও বৃদ্ধি পায়।
৬। সৎআমলের স্থায়ীত্ব ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখাঃ যে ব্যক্তি নেকী অর্জনের মৌসুম অতিবাহিত করার পর সৎআমলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চায়, তার জন্য জরুরী হলো সে যেন সৎআমলে স্থায়ী ও অটল থাকার গুরুত্ব, ফযীলত, উপকারিতা, তার প্রভাব, তা অর্জনের সহায়ক বিষয় ও এক্ষেত্রে সালাফে সালেহীনের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে।
সৎআমলের উপর স্থায়ী ও অটল থাকার গুরুত্ব
ইসলামী শরীয়তে সৎআমলের উপর স্থায়ী ও অটল থাকার গুরুত্ব নিম্নের বিষয়গুলি হতে ফুটে উঠেঃ
১। আল্লাহ তায়ালার ফরযসমূহ, যা অবশ্যই ধারাবাহিতকতার ভিত্তিতেই ফরয করা হয়েছে এবং তা আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল।
২। সৎআমলের স্থায়ীত্ব ও ধারাবাহিকতা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অন্যতম তরীকা ও নীতি।
৩। ক্রমাগত আমল ও তার ধারাবাহিকতা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিকট উত্তম আমলের অন্তর্ভুক্ত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: “আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল হল, যা নিয়মিতভাবে করে যাওয়া হয়, যদিও তা অল্প হয়।” (বুখারী-মুসলিম)
সৎআমলের উপর স্থায়ী ও অটল থাকার প্রভাব ও উপকারিতা:
* আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৎআমলের হেফাযতকারী বান্দাদেরকে বহুভাবে সম্মানিত ও উপকৃত করে থাকেন। যেমন:
১। স্রষ্টার সাথে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ; যা তাকে অগাধ শক্তি, দৃঢ়তা, আল্লাহর সাথে নীবিড় সম্পর্ক ও তার উপর মহা আস্থা তৈরি করে দেয়। এমনকি তার দুঃখ-কষ্ট ও চিন্তা-ভাবনায় আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। যেমন: আল্লাহ তায়ালা বলেন-
অর্থঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করবে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।” (সূরা তালাক: ৩ )
২। অলসতা-উদাসীনতা হতে অন্তরকে ফিরিয়ে রেখে সৎআমলকে আঁকড়ে ধরার প্রতি অভ্যস্ত করা যেন ক্রমান্নয়ে তা সহজ হয়ে যায়। যেমন কথিত রয়েছে: “তুমি তোমার অন্তরকে যদি সৎআমলে পরিচালিত না কর, তবে সে আমাকে গুনাহর দিকে পরিচালিত করবে।”
৩। এ নীতি অবলম্বন হল আল্লাহর মুহাব্বাত ও অভিভাবকত্ব লাভের উপায়। যেমন হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন: “আমার বান্দা নফল ইবাদতসমূহ দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতেই থাকে, এমনকি তাকে আমি মুহাব্বাত করতে শুরু করি— (বুখারী)
৪। সৎআমলে অবিচল থাকা বিপদ-আপদে মুক্তির একটি কারণ। যেমন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) কে উপদেশ দেন: আল্লাহকে হেফাযত কর তিনি তোমাকে হেফাযত করবেন, আল্লাহকে হেফাযত করত, তুমি তাঁকে তোমার সামনে পাবে; সুখে-শান্তিতে তাঁকে চেন। তিনি তোমাকে বিপদে চিনবেন। (মুসনাদে আহমদ)
৫। সৎআমলে অবিচলতা অশ্লীলতা ও মন্দ আমল হতে বিরত রাখে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
অর্থ: “নিশ্চয়ই নামায অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখে।” (সূরা আনকাবূত: ৪৫)
৬। সৎআমলে অবিচল থাকা গুনাহ-খাতা মিটে যাওয়ার একটি কারণ। যেমন: নবী
৭। সৎআমলে স্থায়ী ও অটল থাকা, উত্তম শেষ পরিণামের কারণ। যেমন: আল্লাহ বলেন:
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন: ((তোমাদের কারো দরজায় যদি একটি নদী থাকে, আর সে তাতে প্রতিদিন পাঁচবার করে গোসল করে, তবে তার দেহে কি কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে? সাহাবাগণ বলেন: না, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: এমনই পাঁচ ওয়াক্ত নামায, আল্লাহ যার দ্বারা গুনাহ সমূহকে মিটিয়ে দেন))। (বুখারী-মুসলিম)
অর্থঃ “যারা আমার পথে চেষ্টা-সাধনা করবে অবশ্যই আমি তাদেরকে আমার পথ দেখিয়ে দিব, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎআমল কারীগনের সাথে আছেন”। (সূরা আনকাবূত: ৬৯)
৮। এটি কিয়ামতের দিন হিসাব সহজ হওয়া ও আল্লাহর ক্ষমা লাভের উপায়।
৯। এ নীতি মুনাফেকী হতে অন্তরের পরিশুদ্ধতা ও জাহান্নামের আগুন হতে পরিত্রাণের একটি উপায়। যেমন: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: “যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন (ক্রমাগত) জামাআতের সাথে প্রথম তাকবীর পেয়ে নামায আদায় করবে তার জন্য দু’প্রকার মুক্তির ঘোষণা: (১) জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি ও (২) মুনাফেকী হতে মুক্তি। (তিরমিযী-হাসান)
১০। এটি জান্নাতে প্রবেশের উপায়: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: ((যে ব্যক্তি কোন জিনিসের দু’প্রকার আল্লাহর রাস্তায় খরচ করল, তাকে জান্নাতের দরজাসমূহ হতে আহ্বান করা হবে। জান্নাতের রয়েছে আটটি দরজা: সুতরাং যে ব্যক্তি নামাযী তাকে নামাযের দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে, যে ব্যক্তি জিহাদী তাকে জিহাদের দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে, যে ব্যক্তি দান-খয়রাত ওয়ালা তাকে দান-খয়রাতের দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে এবং যে ব্যক্তি রোযাদার তাকে রাইয়্যান নামক দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে))। (বুখারী-মুসলিম)
১১। যে ব্যক্তি নিয়মিত সৎআমল করে অতঃপর অসুস্থতা, সফর বা অনিচ্ছাকৃত ঘুমের কারণে যদি সে আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে তার জন্য সে আমলের সওয়াব লিখা হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: “বান্দা যখন অসুস্থ হয় বা সফর করে, তবে তার জন্য অনুরূপ সওয়াব লিখা হয় যা সে গৃহে অবস্থানরত অবস্থায় ও সুস্থ অবস্থায় করত।” (বুখারী) এবং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: ((যে ব্যক্তির রাতে নামায ছিল কিন্তু তা হতে নিদ্রা তার উপর প্রভাব বিস্তার করে, তবে আল্লাহ তার জন্য সে নামাযের সওয়াব লিখে দিবেন এবং তার সে নিদ্রা হবে তার জন্য সাদকা স্বরূপ))| (নাসায়ী ও মুয়াত্তা মালেক-সহীহ)
হজের পর করণীয়
বিদায় তাওয়াফ শেষে যেন দুনিয়ায় নবাগত শিশু, ক্ষমাপ্রাপ্ত, প্রশংসনীয় চেষ্টা, গৃহীত আমল ও মাবরুর-গৃহীত হজ (যার প্রতিদান জান্নাত) সমাপ্ত করে ফিরে ধন্য হলো আদম সন্তান।
প্রত্যেকেই চায় হজ আদায়ের জন্য মক্কা যাবে, আল্লাহ তায়ালা কে এর দ্বারা রাজী-খুশী করবে ও ইসলামের পাঁচটি রুকনের পঞ্চম রুকন বাস্তবায়ন করে ধন্য হবে। এমর্মে হাজী সাহেবগণ কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করেন। যাবতীয় কষ্ট অতিক্রম করে কুপ্রবৃত্তির উপর বিজয় লাভ করে তাকওয়ার লেবাস অর্জন করেন।
সুতরাং এ হজ আদায় শেষে নব জন্মের বেশে গুনাহ-খাতা মুক্ত দেশে ফিরে যাবে। তারপর কি পুনরায় পূর্বের ন্যায় পাপাচারে প্রত্যাবর্তন বিবেক সম্মত হবে? অতএব কিভাবে সে তার নব ভুমিষ্ট সাদৃশ মা’সুমতাকে সংরক্ষণ করবে? ও কিভাবে তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সঠিক আমলে অবিচল ও অটল থাকবে? তার জন্যই নিম্নের বিষয়গুলো সবিনয়ে নিবেদন:
প্রথমঃ এ বছর আল্লাহ আমাদের মধ্যে যাকে হজ আদায়ের তাওফীক প্রদান করে ধন্য করেছেন, তাঁর উচিত মাওলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও প্রশংসা করা। কেননা তিনিই তাকে এ মহান ইবাদত সম্পাদন করার সুযোগ ও শক্তি দান করেছেন। যেমন: আল্লাহ তায়ালা বলেন-
অর্থঃ “যখন তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেনঃ তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদেরকে অবশ্যই অধিক দিবো, আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর”। (সূরা ইবরাহীম: ৭)
দ্বিতীয়ঃ যেভাবে হজ সফরে বেশি বেশি দু’আ-যিকির, ইস্তেগফার-ক্ষমাপ্রার্থনা ও নিজের অপারগতা তুলে ধরে কাকুতি-মিনতি পেশ করেছি, পরবর্তীতেও তার ধারাবাহিতকতা বজায় রাখব।
তৃতীয়ঃ আমরা হজ সফরে নিশ্চিত ছিলাম যে, এটি কোন সাধারণ ও বিনোদনমূলক সফর ছিল না; বরং তা ছিল শিক্ষা-দীক্ষার প্রশিক্ষণ কোর্সও একটি ঈমানী সফর। যাতে আমরা চেষ্টা করেছি যাবতীয় গুনাহ-খাতা হতে মুক্তি পাওয়ার, স্বীয়কৃত অন্যায়-অত্যাচার হতে মুক্ত হওয়ার। হজ মাবরুর পেয়ে মা’সুম প্রত্যাবর্তন করার।
সুতরাং হজ যেন পরিবর্তনের কেন্দ্র বিন্দু। উত্তম পথের নব উদ্যোগ, স্বভাব-চরিত্র, আদত-অভ্যাস, আকীদা-বিশ্বাস প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তনের শুভ পদক্ষেপ। অতএব আমরা কি উত্তমতার দিকে পরিবর্তন হবো না? অথচ আল্লাহ বলেন:
অর্থ: “নিশ্চয় আল্লাহ কোন সমপ্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে।” (সূরা রা’দ: ১১)
চতুর্থঃ হজ সফরে আমরা ঈমানের মজা এবং সৎকর্মের স্বাদ অনুভব করেছি, আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের গুরুত্বও জেনেছি, হেদায়েতের পথে চলেছি। সুতরাং এ সবের পর আমরা কি তা পরবর্তী জীবনে জারী রাখব না? ও ভ্রষ্টতা থেকে বেঁচে থাকব না? আল্লাহ তায়ালা বলেন:
অর্থ: নিশ্চয়ই যারা বলেঃ আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, অতঃপর অবিচলিত থাকে, তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় ফেরেশ্‌তা এবং বলেঃ তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার সুসংবাদ পেয়ে আনন্দিত হও।” (সূরা ফুসসিলাত: ৩০)
আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন:
অর্থ: “অতএব, তুমি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছো, দৃঢ় থাকো এবং সেই লোকেরাও যারা (কুফরী হতে) তাওবা করে তোমার সাথে রয়েছে, সীমালঙ্ঘন কর না; নিশ্চয় তিনি তোমাদের কার্যকলাপ সম্যকভাবে প্রত্যক্ষ করেন।” (সূরা হুদ: ১১২)
পঞ্চমঃ হালাল অর্থে আমরা হজের সুযোগ গ্রহণ করেছি, পোশাক, পানাহার পবিত্র ও হালাল গ্রহণ করেছি এবং হালালের যে বরকত তাও উপলব্ধি করেছি। অতএব অবশিষ্ট জীবনে তা কি ধরে রাখব না?
ষষ্ঠঃ সেই ঈমানী সফর থেকে আমরা বের হয়েছি যাতে আমরা মৃত্যু ও তার যন্ত্রণা, কবর ও তার আযাব এবং কিয়ামত ও তার ভয়াবহতা খুব করে স্মরণ করেছি বিশেষ করে কাফন সাদৃশ ইহরামের গোসল ও বস্ত্র পরিধানের সময়। এগুলো কি আমরা সর্বদা স্মরণ রাখব না? যে বিষয়গুলি আমাদেরকে হকের পথে, হেদায়াতের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবে এবং মৃত্যু পর্যন্ত সৎকর্মে অবিচল ও হারাম থেকে বেঁচে থাকার প্রতি উৎসাহ দিবে।
সপ্তমঃ হজ সফরে আমরা স্মরণ করেছি নবীদের, অনুসরণ করেছি আমাদের পিতা ইবরাহীম খলীলের। যিনি তাওহীদের পতাকাকে সমুন্নত করেন, ইখলাসের শিক্ষা দেন। অতএব আমরা হজে আল্লাহর জন্য ইখলাসকে আঁকড়ে ধরি এবং আমাদের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাত ও তরীকাকে অনুসরণ করি যেন আমাদের আমলগুলি গ্রহণযোগ্য হয়। অবশিষ্ট জীবন কি এমর্মে অতিবাহিত করা উচিত হবে না।
অষ্টমঃ হজের পূর্বে আমরা তাওবায় সচেষ্ট হই এবং অন্যের প্রতি যুলুম-অন্যায় ও অবিচার হয়ে থাকলে তা হতে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছি। মূলতঃ এ নীতি অবলম্বন তো সব সময়ের জন্যই।
নবমঃ হজের পূর্বে আমরা তাকওয়া-আল্লাহভীতি যথাযথ অবলম্বন করেছি। আমাদের অন্তরকে পাপাচার, গুনাহ ও অশ্লীলতা হতে দূরে রেখেছি। অনার্থক ঝগড়-বিবাদ পরিত্যাগ করেছি, যা আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে নির্দেশও করেন:
অর্থ: “কেউ যদি ঐ মাসগুলোর মধ্যে হজ্জের সংকল্প করে, তবে সে হজ্জের মধ্যে সহবাস, দুষ্কার্য ও কলহ করতে পারবে না এবং তোমরা যে কোন সৎকর্ম কর না কেন, আল্লাহ তা পরিজ্ঞাত আছেন; আর তোমরা (নিজেদের) পাথেয় সঞ্চয় করে নাও; বস্তুতঃ নিশ্চিত উৎকৃষ্টতম পাথেয় হচ্ছে আল্লাহভীতি এবং হে জ্ঞানবানগণ! তোমরা আমাকে ভয় কর।” (সূরাঃ বাকারা: ১৯৭)
আর তাকওয়া এমন জিনিস যা সর্বাবস্থায় জরুরী, হজের পূর্বে এবং পরেও। সুতরাং আমরা কি যাবতীয় হারাম হতে বেঁচে থাকার, আমাদের ও আল্লাহ যা হারাম করেছেন তার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করব না। আর যা সৃষ্টি হবে, তাঁর আদেশসমূহ মান্য ও নিষেধসমূহ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমেই। যে এমন করবে অবশ্যই আল্লাহ তার জন্য এমন পথ খুলে দিবেন ও এমন তাকে রুযী দান করবেন যা সে কল্পনাও করে না।
দশমঃ হজ পরবর্তীতে আমরা অহংকার-বড়ত্ব প্রকাশ ও রিয়া অর্থাৎ লোকদেরকে স্বীয় আমলের প্রদর্শন জানিয়ে শুনিয়ে দেখিয়ে নিজে তৃপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকব। কেননা এমন মানসিকতা সৎআমল নষ্ট করে দেয়।
একাদশঃ নিজেকে হজের মাধ্যমে সম্মানিত জাহের করা; তা হাজী, আলহাজ ইত্যাদি টাইটেল গ্রহণ ও প্রচার করে বা এ টাইটেলকে পুঁজি করে দুনিয়াবী স্বার্থ অর্জন। এ নীতি আমলটিকে নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।
* হজ পরবর্তীতে দুনিয়াবী লোভ-লালসার প্রাধান্য ও পূর্ণ দুনিয়াদার হওয়া যেমন দোষণীয়, অনুরূপ হালাল রীতি অনুযায়ী ও উপযোগী পর্যায়ে দুনিয়াবী ব্যস্ততাকে বর্জন করে সংসার ত্যাগীও হওয়া ঠিক হবে না।
দ্বাদশঃ হজের সফরে আমরা বহু শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করেছি। তার মধ্যে অন্যতম হল আল্লাহর জন্য নিজেকে সোপর্দ করে দেয়া। এর মধ্যে রয়েছে পিতা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম), তার ছেলে ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম) ও তার মাতা হাজেরার অনুসরণ।
অতএব এ শিক্ষা হতে আমাদেরকে উক্ত ত্যাগ-তিতীক্ষা ও শিক্ষা নিতে হবে।
সংকলনঃ: মুহাম্মাদ আব্দুর রব আফ্‌ফান

Share this

Related Posts

Previous
Next Post »