পরম করুনাময় আল্লাহ্ এর নামে শুরু করলাম
আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই? আশা করি ভালই আছেন, আমি ও আমরা আপনাদের দোয়ায় এবং আল্লাহ্র অশেষ রহমতে অনেক ভাল আছি। তবে আর কথা বাড়িয়ে লাভ কি? বেশি কথা না বাড়িয়ে কাজের কথায় আসি।
————————————————————————————————————————————–
পূর্বের পর্ব দেখতে এখানে ক্লিক করুন
দেন-মোহর গ্রহণ করা নববধুর গুরুত্বপূর্ণ অধিকারঃ
দেন-মোহরের টাকা স্বীয় স্বামীর নিকট হতে করা-গন্ডায় বুঝে নেয়া প্রতিটি বধূর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক বধূরাই তাদের এ অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছে অসচেতনতার কারণে। অথচ শাশ্বত ধর্ম ইসলাম মুসলিম নারীকে যতগুলো অধিকার দিয়েছে, তন্মধ্যে দেন-মোহর একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অধিকার। বিবাহ বন্ধনের ফলে বধূর নিজেকে স্বামীর প্রতি অর্পণ করার বিনিময়ে স্বামীর নিকট হতে শরীয়ত সম্মতভাবে যে অর্থ লাভের অধিকারী হয়, সে অর্থকে “মোহরানা” বলা হয়। বিশিষ্ট ফকীহ ও মুহাদ্দিস শাওকানীর মতে, দেন-মোহর বধূর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তার মনকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশেই ধার্য করা হয়েছে। জনৈক আলেম বলেছেন, দেন-মোহর দ্বারা স্ত্রীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানও এক বিশেষ লক্ষ্য। কেউ কেউ বলেছেন, স্ত্রীকে মর্যাদার স্বীকৃতি স্বরুপ দেন-মোহর একটি আবশ্যকীয় দায়িত্ব। এ দায়িত্ব এত গুরুত্বপূর্ণ যে, বিবাহের সময় তা নির্ধারণের ব্যবস্থা রয়েছে।
যদি কোন বিবাহ এই শর্তে হয় যে, কোন মোহরানা থাকবে না, তবুও বিবাহ সহীহ হয়ে যাবে, তবে স্বামী তার স্ত্রীকে মোহরে মিছাল দিতে বাধ্য থাকবে। মোহর ব্যতীত বিবাহ হওয়ার পর স্ত্রী যখন ইচ্ছা মোহরে মিছালের দাবী করতে পারবে। যদি সহবাসের পূর্বেই স্ত্রী মারা যায়, তবূও স্বামীর নিকট থেকে মোহরে মিছাল গ্রহণ করা হবে। এমনিভাবে যদি সহবাসের পূর্বে স্বামী মারা যায়, তাহলে স্ত্রী মোহরে মিছালের অধিকারী হবে এবং এ আবশ্যকীয় হক স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তি হতে আদায় করতে হবে। আর স্ত্রী স্বামীর উত্তরাধীকারী হিসাবে অংশ পাবে, সেটি ভিন্ন।
ইসলাম নারীর দেন-মোহর অধিকারটিকে খুব গুরূত্ব দিয়েছে। দেন-মোহর আদায় পুরুষের জন্য ফরীযাহ (বা ফরয) বলা হয়েছে। মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কুরআনে ইরশাদ হযেছে:
“এদের (মুহাররামাত) কে ছাড়া তোমাদের জন্য সব নারী হালাল করা হয়েছে এই শর্তে যে, তোমরা তাদেরকে স্বীয় অর্থের (দেন-মোহরের) বিনিময়ে তলব করবে, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য; ব্যভিচারের জন্য নয়। অনন্তর তাদের মধ্যে যাদেরকে তোমরা ভোগ করবে, তাকে তার নির্ধারিত (দেন-মোহর) হক আদায় কর।” -সূরা নিসাঃ৫,২৪।
ইসলামপূর্ব অজ্ঞতার যুগে স্ত্রী হিসেবে নারীর কোন মূল্যই ছিল না্। তাই নারীর নারীত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক দেন-মোহর আদায়ের প্রশ্নই উঠত না। যে সমস্ত পরিবারে বা বংশে নামকাওয়াস্তে মহর ধার্য করা হত, সেখানে স্ত্রীদের মোহরের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের অবিচার ও জুলুমের প্রথা প্রচলিত ছিল। যেমন-
স্ত্রীর প্রাপ্য মোহর তার হাতে পৌছানো হতো না; মেয়ের অভিভাবকরাই তা আত্মসাৎ করতো। যা ছিল নিতান্তই একটা নির্যাতনামূলক রিওয়াজ্। এ প্রথা উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে কুরআন পাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে : “নারীদের মোহর দাও খুশির সাথে।” -সুরা নিসাঃ৪
এতে স্বামীর প্রতি নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, স্ত্রীর মোহর তাকেই পরিশোধ কর; অন্যকে নয়। অন্যদিকে অভিভাবদেরকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, মোহর আদায় হলে, তা যার প্রাপ্য, তার হাতেই যেন অর্পণ করে। তাদের অনুমতি ছাড়া অন্য কেই যেন তা খরচ না কর্।
স্ত্রীর মোহর পরিশোধ করার ক্ষেত্রে নানা রকম তিক্ততার সৃষ্টি হতো্ প্রথমত : মোহর পরিশোধ করতে হলে, মনে করা হতো- যেন জরিমানার অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। এ অনাচার রোধ করার লক্ষেই আয়াতে নিহলা শব্দটি ব্যবহার করে অত্যন্ত হৃষ্টমনে তা পরিশোধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেননা, অভিধানে “নিহলা” বলা হয়, যে দান অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে প্রদান করা হয়।
মোটকথা, আয়াতে বলে দেয়া হয়েছে যে, স্ত্রীদের মোহর অবশ্য পরিশোধ্য একটা ঋণ বিশেষ।এটা পরিশোধ করা অত্যন্ত জরুরী। পরন্তু অন্যান্য ওযাজিব ঋণ যেমন সন্তুষ্ট চিত্তে পরিশোধ করা হয়, স্ত্রীর মোহরের ঋণও তেমনি হৃষ্টচিত্তে, উদার মনে পরিশোধ করা কতব্য।
অনেক স্বামীই তার বিবাহিত স্ত্রীকে অসহায় মনে করে নানাভাবে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে মোহর মাফ করিয়ে নিতো। এভাবে মাফ করিয়ে নিলে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা মাফ হয় না। অথচ স্বামী মনে করত যে, মৌখিকভাবে যখন স্বীকার করিয়ে নেয়া গেছে, সুতরাং মোহরের ঋণ মাফ হয়ে গেছে। এ ধরণের জুলুম প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে :
“যদি স্ত্রী নিজের পক্ষ থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মোহরের কোন অংশ ক্ষমা করে দেয়, তবেই তোমরা তা হৃষ্টমনে ভোগ করতে পারবে।” -সূরা নিসা
এর অর্থ হচ্ছে, চাপ প্রয়োগ কিংবা কোন প্রকার জোর-জবরদস্তি করে ক্ষমা করিয়ে নেয়ার অর্থ কোন অবস্থাতেই ক্ষমা নয়। তবে স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায়, খুশি মনে মোহরের অংশ বিশেষ মাফ করে দেয় কিংবা পুরোপুরিভাবে বুঝে নিয়ে কোন অংশ তোমাদের ফিরিয়ে দেয়, তবেই তা আমাদের পক্ষে ভোগ করা জায়েয হবে।
এ ধরণের বহু নির্যাতনমূলক প্রথ জাহেলিয়্যাত যুগে প্রচলিত ছিল। কুরাআন এসব জুলুমের উচ্ছেদ করেছে।কিন্তু পরিতাপের বিষয, আজও মুসলিম সমাজে মোহর সম্পর্কিত এ ধরনের নানা নির্যাতনমুলক ব্যবস্থা প্রচলিত দেখা যায়। কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী, এরুপ নির্যাতনমূলক পথ পরিহার করা অবশ্য কর্তব্য।
যেহেতু আমাদের মুসলিম সমাজে নারী জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার “মোহর” নিয়ে নানা কুসংস্কার, রকমারী অজ্ঞতা ও অনিয়ম প্রচলিত রয়েছে। ফলে নারী সমাজ হচ্ছে নিশ্চিত ও অনিবার্য প্রবঞ্চনার শিকার। অথচ নারী জাতি আমাদের সমাজের প্রায় অর্ধেক। সেই কন্যা, জায়া, জননীর প্রবঞ্চনার পরিণতি বড় করুন, ভয়াবহ ও নির্মম। একে অস্বীকার করার উপায় নেই। নারী সমাজ বঞ্চিত হলে মানবতাই বঞ্চিত হয়।মানবাধিকার লংঘন হয়। মানবতা অপমানিত ও পরাজিত হয়। ফলে পরিবারে ভাঙ্গন, সমাজে অশান্তি আর রাষ্ট্রে বিশৃংখলা অনিবার্য হয়ে উঠে। আজকের সমাজ ব্যবস্থা এর বাস্তব প্রতিচ্ছবি। এর নিরাময় হতে পারে অজ্ঞতা দূরীকরণ, সংস্কার সাধন, শরীয়া আইনের বাস্তব প্রয়োগ ও অনুশীলনের মাধ্যমে।
আমাদের সমাজের অর্ধেকই যেহেতু নারী, তা “মোহর” সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, কু-প্রথা দূরীকরণে নারী সমাজকে সচেতন হতে হবে। সেই নারী সমাজকে সচেতন করার নিমিত্তে “মোহর” সম্পর্কে স্বল্প-বিস্তার অথচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উপস্থাপন করা সমীচীন মনে করছি।
মহর মাফ করিয়ে নিলে কি কি ক্ষতি হয়ঃ
(১)কুরআনের ফরজ অধিকার নিয়ে তামাশা করা জন্য সমাজ হয় পাপিষ্ট।
(২)মানুষ হয় প্রতারক, ধোঁকাবাজ।
(৩)বর প্রথম রাতে স্ত্রীর কাছে মাফ চেয়ে পৌরুষত্বের চরম অপমান করে।
(৪)নারীরা হয় বঞ্চিতা, অধিকার হারা।
(৫)স্ত্রীর অন্তরে স্বামীর প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
(৬)দাম্পত্য জীবনে আসে অশান্তি।
(৭)পরিবারে সৃষ্টি হয় ভাঙ্গন।
(৮)সমাজে নেমে আসে বিপর্যয়।
(৯)রাষ্ট্রে দেখা দেয় বিশৃংঙ্খলা।
(১০)শিশু সন্তানেরা হয় নীড় হারা পাখির মতো। মা-বাবা ও পরিবারের আপনজনের আদর ও সোহাগ থেকে বঞ্চিত, নাম হয় টোকাই, আর পথকলি। সুতরাং মানবতার স্বার্থে এ প্রবণতা রোধ করা প্রয়োজন।
ফকীহগণ বলেছেন, মোহর মাফ চেয়ে নেলে, অথবা ছলে-বলে, কৌশলে বা চাপ প্রয়োগ করে মাফ করিয়ে নিলে মাফ হবে না।
কুরআনুল কারীমে ইশাদ হয়েছে: “আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর স্বেচ্ছায় খুশি মনে দিয়ে দাও।তারা যদি খুশি হয়ে কিঞ্চিত ছাড় দেয়; তবে তা তোমরা সাচ্ছন্দে ভোগ কর।
এ আয়াতের ব্যাখায় তাফসীর-ই-মা’আরিফুল কুরআনে মুফতী শফি (রহ.) লিখেছেন যে, চাপ প্রয়োগ কিংবা কোন প্রকার জোর জবরদস্তি করে ক্ষমা করিয়ে নেওয়ার অর্থ কোন অবস্থাতেই ক্ষমা নয়। তবে স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় খুশি হয়ে মোহরের অংশ বিশেষ মাফ করে দেয় কিংবা পুরোপুরিভাবে বুঝে নিয়ে কোন অংশ তোমাদের ফিরিয়ে দেয়, তবেই কেবল তা তোমাদের জন্য ভোগ করা জায়েয় হবে। এর পূর্বে স্ত্রীর সম্পদে যে কোনরুপ হস্তক্ষেপ অবৈধ।
এ ধরনের বহু নির্যাতনমূলক প্রথা জাহেলিয়্যাতের যুগে প্রচরিত ছিল। কুলআন এসব জুলুমের উচ্ছেদ করেছে। কিন্তু পরিতাপের ষিয়, আজও মুসলিম সমাজে ‘মোহর’ সম্পর্কিত এ ধরেণর নির্যাতনমূলক পথ পরিহার করা আবশ্য কর্তব্য। আয়াতে হৃষ্ট চিত্তে মোহর প্রদানের শর্ত আরোপ করার পেছনে গভীর তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। কেননা, মোহর স্ত্রীর অধিকার এবং তা নিজস্ব সম্পদ। হৃষ্ট চিত্তে যদি সে তা কাউকে না দেয় বা দাবি ত্যাগ না করে তাহলে স্বামী বা অভিভাবকের পক্ষি সে সম্পদে হস্তক্ষেপ করা কোন অবস্থাতেই হালাল হবে না।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্রাম এক হাদসে শরীয়তের মূলনীতিরুপে ইরশাদ করেছেন: “সাবধান, জুলুম কর না। মনে রেখ, কারো পক্ষে অন্যের সম্পদ তার আন্তরিক তুষ্টি ব্যতীত গ্রহণ করা হালাল হবে না। -(মিশকাত/২৪৫)
এ হাদীসটি এমন একটি মূলনীতির নির্দেশ দেয়, যা সর্ব প্রকার প্রাপ্য ও লেন-দেনের ব্যাপারে হালাল ও হারামের সীমারেখা নির্দেশ করে। তােই মাফ করিয়ে নেয়ার জঘন্যতম কুপ্রথা পরিহার করা প্রতিটি সুস্থ বিবেকবান মুসলমানের কর্তব্য।
দেন-মোহর মাফ করিয়ে নেয়ার এক অমানবিক পন্থাঃ
প্রাসঙ্গিক একটা বিষয়, যা উল্লেখ না করলেই নয়। দেশের কোন কোন এলাকায় কু-প্রথা আছে যে, স্বমী মারা গেলে কিছু নিকটাত্মীয়, মাতব্বার, কোন কোন মসজিদে দুবৃল ইমাম সাহেবসহ বিধবা স্ত্রীর কাছে দল বেঁধে উপস্থিত হয়ে বলেন, মোহরের দাবি মাফ করে দাও, নতুবা স্বামীর কবরে আযাব হবে।
লক্ষ করুন, একজন মহিলার জীবনসঙ্গী মারা গেছে। সে এখন অসহায়, বিধবা। তার সন্তানেবা এতিম, বুকফাটা আর্তনাদ, আর আপন হারানোর বেদনায় মুহ্যমান্ এমনই এক নাজুক সময়ে মুরব্বী, আত্মীয় ও ইমামের প্রস্তাবনা….মোহর মাফ না করলে কবরে আযাব হবে! প্রবঞ্চনার কী বিভৎস রুপ? একটা নারী তার সবচাইতে আপন মানুষটির লাশ সামনে নিয়ে, এতীমদের পাশে নিয়ে শোকে কাতর। এখন তার সামনে প্রস্তাবনার দু’টি দিক্ এর যে কোন একটিকে গ্রহণ করতে হব।(১) হয় মোহর মাফ করতে হবে,নতুবা (২) স্বামীর কবরের আযাব মেনে নিতে হবে।
এমনি এক মুহূর্তে উক্ত রু প্রস্তাবনাকে অগ্রাহ্য করে কোন মহিলা কি মোহর মাফের স্বীকৃতি না দিয়ে পারে? অথচ এটা ইকটা ভিত্তিহীন বক্তব্য, বানোয়াট প্রথা, জঘণ্যতাম বিদআত। নারীকে তার শরীয়া নির্ধাততে হক থেকে বঞ্চিত করার এক অমানবিক কৌশল। সুতরাং দোশের কোন অঞ্চলে যেন এরুপ প্রথা চলতে না পারে, সে জন্য সকল নারী পুরুষকে সচেতন ভূমিকা পালন্ করা একান্ত আবশ্যক।
———————————————————————————————————————————————-
পরবর্তী পর্ব দেখতে এখানে ক্লিক করুন
তাহলে আজ এই পর্যন্তই আলোচনা রাখলাম, আবার পরবর্তি পোষ্ট নিয়ে খুব তারাতারিই আপনাদের মাঝে হাজির হব, ততক্ষন আমাদের থাকুন।
ভাল লাগলে কমেন্টে জানাতে ভুলবে না…
ভুলে ভরা জীবনে ভুল হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়,যদি আমার লেখার মাঝে কোন ভুলত্রুটি থাকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ সবাই ভাল থাকবেন।
আমাদের ইসলামিক পেজসবকিছু২৪ ডট কম