ইসলামে বিয়ের গুরুত্ব! (পর্ব- ০১)

বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যেক ধর্মেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কোন ধর্মেই বিয়ে বিহীন সহবস্থান গ্রহণ করে না, সভ্য সমাজে বিয়ে বিহীন জোটিকে অন্য নজরে দেখা হয়। ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বক্ষমান প্রবন্ধে আমরা বিয়ে সংক্রান্ত খুটি-নাটি বিষয় যেমন বিয়ের প্রয়োজনীয়তা, পাত্র-পাত্র নির্বাচন করা, বিয়ে প্রচলিত কুপ্রথা ও তা হতে বাঁচার উপায়, যৌতুক, আদর্শ বিয়ের কিছু উদাহরণ,বিয়ের প্রস্তাব করণীয় ও বর্জনীয়, সৌভাগ্যময় জীবনের পূর্ণাঙ্গ উপায়, সদ্যবিবাহিত ছেলে-মেয়েদের জন্য অমূল্য উপদেশ ইত্যাদি বিষয় আলোকপাত করা হবে, ইনশা আল্লাহ। আশা করি এ ধারাবাহিকটি ধৈর্যসহাকারে পাঠকগণ পড়বেন। আল্লাহ সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন
মানুষ সমাজে একে অন্যের সাহচর্য নিয়ে বসবাস করে থাকে। পরিবার ও সমাজ ছাডা নিজে একাকী বসবাস কষ্টকর ও বলতে গেলে অসম্ভব। ছোট থেকে যুব ও পরিণত বয়সে সুখ-দুঃখ, মায়া-মমতা, সেবা-শুশ্রƒষাসহ সব কার্যক্রম পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে। সুশৃঙ্খল ও স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহের জন্য প্রয়োজন পবিত্র ও সুসভ্য সামাজিক ব্যবসস্থা। যে ব্যবসস্থার মধ্যে থাকা চাই পরিপূর্ণ ও সব পর্যায়ে মঙ্গলকর নির্দেশনা। আর এ নির্দেশনা পাওয়া যায় ইসলাম ধর্মে। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবসস্থা।

ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে সুন্দর ও পবিত্র জীবনযাপনের জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওযার ব্যবসস্থা করেছে। বল্গাহীন স্বেচ্ছাচারী জীবনের উচ্ছৃঙ্খলতামুক্ত ও নোংরামিপনার অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির মায়া-মমতার বন্ধনে আবদ্ধিত জীবনের সন্ধান দিয়েছে। নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিবাহ হচ্ছে একমাত্র বৈধ উপায় এবং মানুষের চরিত্র ও সতীত্বকে রক্ষার হাতিয়ার। বিয়ের মাধ্যমে পারিবারিক জীবনে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং পরস্পরের মধ্যে অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের অপরিহার্যতা আরোপিত হয়।

বিভিন্ন ধর্মে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে কিছু ধারণা দেওয়া হল :
হিন্দু ধর্মে বিয়ে : পাত্র-পাত্রী পছন্দ এবং উভয় পরিবারের সমঝোতার পর শুভ দিন এবং শুভ তিথি বা লগ্ন নির্ধারণ করা হয়। ওই তারিখ এবং সময়ে উভয়পক্ষের ২ জন ব্রাহ্মণ এবং অভিভাবকদের উপস্থিতিতে বিবাহ কার্য সম্পাদন করা হয়। বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার আগে উভয়পক্ষের ব্রাহ্মণরা পাত্র এবং পাত্রী দু’জনকে কিছু প্রতিজ্ঞা, প্রতিশ্রুতি এবং শর্ত জুড়ে দেন। পাত্র-পাত্রী উভয়েই ওই শর্ত মেনে নিয়ে সম্মতি প্রকাশ করলেই বিবাহ কার্য শুরু হয়। একটি ব্যাপার এখানে লক্ষণীয়, বিবাহের বেঁধে দেয়া লগ্ন বা সময় পেরিয়ে গেলে বিবাহ কার্য সম্পাদন করা যাবে না। পরবর্তী চন্দ্র মাসের তারিখ অনুযায়ী পুনরায় লগ্ন নির্ধারণ করা হয় এবং তারপরই কেবল বিবাহ কার্য সম্পাদন করা যাবে। বিবাহের আগের দিন বর-কনে উভয়কেই সংযম পালন করতে হয়। অর্থাৎ শুধু উপবাস করে থাকতে হয় এবং বিবাহের দিনও উভয়েই উপোস থাকে। বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পরই কেবল পাত্র-পাত্রী খাবার গ্রহণ করতে পারে।

খ্রীষ্টান ধর্মে বিয়ে : পাত্র-পাত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর উভয় পরিবারের সম্মতি নিয়ে গির্জায় একজন ফাদার বা পাদ্রিকে জানাতে হয়। জানানোর পর ফাদার গির্জায় আগত সবার সামনে ঘোষণা করেন, এ পাত্রীর সঙ্গে অমুক পাত্রের বিবাহ সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে উপস্থিত আপনাদের কারও কোনও মন্তব্য বা বক্তব্য থাকলে বলতে পারেন। এ ঘোষণার পর থেকে পাত্রী তিন সপ্তাহ ধরে ওই গির্জায় প্রার্থনার জন্য যাতায়াত করেন। ওই তিন সপ্তাহ চলাকালীন সময়ে কারও কোনও প্রকার অভিযোগ না থাকলে ৪র্থ সপ্তাহে বিবাহের দিন ধার্য করা হবে। অর্থাৎ সবার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পাওয়ার পর দুই পরিবার বিয়ের আয়োজন শুরু করে থাকে। নির্ধারিত তারিখে নির্ধারিত কোনও গির্জায় ফাদার কর্তৃক পবিত্র বাইবেল পাঠের মাধ্যমে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়।

বৌদ্ধ ধর্মে বিয়ে : প্রথমেই ছেলের পক্ষ থেকে পাত্রী নির্বাচন করা হয়। পরে উভয়পক্ষের অভিভাবকদের সমঝোতার ভিত্তিতে এনগেজমেন্টের তারিখ নির্ধারণ করে সেই তারিখেই এনগেজমেন্টের আনুষ্ঠানিকতা পালন করার পর বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়।


বিয়ের তারিখের আগের দিন পাত্র এবং পাত্রী উভয়েই তাদের নিজ নিজ মন্দিরে বাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করার পর পাত্র এবং পাত্রী উভয়ে তাদের নিকট আত্মীয়-স্বজন নিয়ে বৌদ্ধ মন্দিরে একজন পুরোহিতের কাছে উপস্থিত হন। সেখানেই মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে বিয়ে পড়ানো হয়। একে বলা হয় মঙ্গলাচরণ। বিয়ের দিন কমিউনিটি সেন্টার বা পাত্রীর বাড়িতে বিয়ের সামাজিকতা বা আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়। অর্থাৎ সেখানে পাত্র-পাত্রী উভয়কে কিছু মন্ত্র পাঠের পর সদুপদেশ দেয়া হয় তাদের ভবিষ্যৎ সুখী-সমৃদ্ধ দাম্পত্য জীবনের জন্য। তবে এখানে কাবিন জাতীয় কোন প্রকার শর্তারোপ থাকে না।

ইসলাম ধর্মে বিয়ে: মুসলিম আইন উৎসগত দিক থেকে কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস নির্ভর। শরীয়া আইন থেকেই বিয়ে সংক্রান্ত বিধানসমূহ অনুসৃত হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মে বিয়ে একটি আইনগত, সামাজিক ও ধর্মীয় মর্যাদা রয়েছে। ছেলে ও মেয়ের একসাথে জীবন-যাপন ও সংসার ধর্ম পালনকে আইনগত, ধর্মীয় ও সামাজিক সুরক্ষা দিতেই বিবাহ প্রথার জন্ম। মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে হলো দেওয়ানী চুক্তি। এখানে খুব বেশি আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় না। অন্যান্য চুক্তির মতই এতে দুটি পক্ষ থাকে। সাক্ষীদের উপস্থিতিতে একপক্ষ বিয়ের প্রস্তাব করলে এবং অন্যপক্ষ তা গ্রহণ করলে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়। মুসলিম বিয়েতে মহর বাধ্যতামূলক, আর বিয়ের পর ছেলের বাড়িতে অলিমা (বৌভাতের আয়োজন) করা সুন্নত।

মানুষ যখন বৈধ সম্পর্ক তথা বিয়েতে আবদ্য না হয়ে সাধারণভাবে যৌন চাহিদা পূরণ করে থাকে। এমন যৌনাচারকে ব্যভিচার বলা হয়। ব্যভিচার এমন এক ধ্বংসাত্মক কলুষতা যা মানুষকে সবদিক দিয়ে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি যে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন ছিলো তা বিবেকবান ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন। শুধু প্রতিরোধ করাই যথেষ্ট নয়, যেমন খ্রীষ্টান ও অন্য জাতিসমূহ তার পরিণামফল ভোগ করছে-বরং তার জন্য প্রয়োজন ছিলো এক স্বতন্ত্র আইন-কানুন ও বিধি-বিধান। ইসলাম তাই করেছে। সে মানুষের প্রকৃতি পরখ করেছে এবং সেই মুতাবিক চিকিৎসা ও সতর্কতার তাকীদ দিয়েছে। ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতো  বাড়াবাড়ির পথ অবলম্বন করেনি, বরং মানব-প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য করে ভারসাম্যের পন্থা পছন্দ করেছে।

বিবাহের নির্দেশ ঃ ব্যভিচারের অপকারিতা বর্ণনা করার পর আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, পুরুষ ও নারী যারই বিয়ের প্রয়োজন দেখা দেবে, সে-ই অবশ্যম্ভাবীরূপে বিয়ে করবে। কেননা, বিয়েই হচ্ছে যৌন পবিত্রতা সংরক্ষণ ও যৌন ক্ষুধা নিবারণের সবচেয়ে বড় উপায় ও মাধ্যম। তাই আল্লাহ রব্বুল ইযযত বিয়ের নির্দেশ দিতে গিয়ে বলেছেন ঃ ‘তোমাদের মধ্যে যারা জুড়িহীন, তাদের বিয়ে করিয়ে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা উপযুক্ত তাদেরও।’ (সূরা নূর ঃ ৩২)

আল্লাহ তা‘আলা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের তাকীদ দান করেছেন এবং যে-সব নারী-পুরুষের বিয়ে করা প্রয়োজন, তাদের সবাইকে বিয়ে করানোর নির্দেশ দিয়েছেন। আর এ দায়িত্ব আল্লাহ অর্পণ করেছেন গোটা জাতির ওপর, যাতে তারা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে। এ ব্যবস্থার দ্বারা আল্লাহ পাক এটাই বুঝাতে চান যে, বিয়ে-শাদীর দরুন যে উপকার লাভ হয়, গোটা জাতি তার দ্বারা উপকৃত হয়। আর বিয়ে না করার দরুন যে ক্ষতি সাধিত হয়, তাও গোটা জাতিকেই বহন করতে হয়। বস্তুত বৈধ বিবাহ প্রথা রহিত করে দিলে গোটা জাতীয় চরিত্রই যে তাতে পুঁতিগন্ধময় হয়ে উঠবে, কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তিই তা অস্বীকার করতে পারবেন না। উক্ত আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ পাক আরো বলেছেন যে, কোনো কল্পিত আশঙ্কাকে অজুহাত হিসাবে দাঁড় করিয়ে এই শুভ পরিণয় থেকে বিরত থাকা অবাঞ্ছনীয়।

Share this

Related Posts

Previous
Next Post »