আজকাল অনেককে রিংটোন হিসেবে আজান, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির ইত্যাদি ব্যবহার করতে দেখা যায়। দীনদার ও ধার্মিক শ্রেণীর লোকদের দ্বারাই এ কাজটি সাধারণত বেশি হয়। আমার মনে হয়, তারা এ কাজটি এ ধারণায় করে থাকেন যেÑ অন্যেরা যখন গান, বাজনা ইত্যাদিকে রিংটোন হিসেবে ব্যবহার করে, আমরাও তাদের মোকাবেলায় আজান, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি ভালো জিনিসকে রিংটোন হিসেবে ব্যবহার করব। যাতে মোবাইল ফোনের রিংটোনের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও গান-বাদ্যের পরিমাণ হ্রাস পায়!
এসব লোকের নিয়ত ভালো। এমন সুন্দর নিয়তের কারণে তারা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু যেহেতু বেশ কয়েকটি কারণে শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে রিংটোন হিসেবে এগুলোর ব্যবহার জায়েয নেই তাই এসব থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। নিম্নে আজান ইত্যাদি রিংটোন হিসেবে ব্যবহার নাজায়েয হওয়ার কারণগুলো তুলে ধরা হলো। (ক) আজান আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদ, বড়ত্ব ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের সাক্ষ্য সম্বলিত কিছু বাক্যের সমষ্টি যা ইসলামি শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিআর বা প্রতীক। অনুরূপভাবে পবিত্র কুরআনের আয়াত ও আল্লাহ তা‘আলার নামের জিকির যে কত মর্যাদাপূর্ণ বিষয় তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। এদিকে মোবাইলে রিং আসার অর্থ হলো, আপনাকে একথা অবহিত করা যে, কেউ আপনার সাথে কথা বলতে চায়। এখন ‘কেউ আপনার সাথে কথা বলতে চায়’ এই খবরটুকু দেওয়ার জন্য কি মহান আল্লাহর বড়ত্ব সম্বলিত আজান ও মহামর্যাদাপূর্ণ কুরআনের আয়াত বা জিকির ব্যবহার করা সমীচীন? এসব আওয়াজকে এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করাটা পবিত্র শব্দসমূহকে অবমাননা ও অপাত্রে ব্যবহার করার শামিল নয় কি ?
কোনো বিক্রেতা যদি ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্য জোরে জোরে সুবহানাল্লাহ বলে কিংবা কোনো পাহারাদার যদি জোরে জোরে জিকির করার মাধ্যমে নিজের জাগ্রত থাকার বিষয়টি লোকজনকে অবহিত করে তাহলে ফিকাহবিদগণ একেও পবিত্র শব্দসমূহের অপব্যবহার বলে আখ্যা দিয়েছেন। এবার আপনারাই চিন্তা করে দেখুন, এসব ক্ষেত্রে যদি জিকিরের ব্যবহার ‘পবিত্র শব্দসমূহের অপব্যবহার’ হয়ে থাকে তাহলে ‘মোবাইলে কল এসেছে’ যেন এ খবর দেওয়ার জন্য কুরআন তিলাওয়াত, আজান ইত্যাদির ব্যবহার কেমন হবে? (খ) মোবাইল নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করার পর রিং আসলে অপবিত্র স্থানে পবিত্র তিলাওয়াত, আজান, জিকির ইত্যাদি বেজে উঠবে। এতে এগুলোর পবিত্রতা কত মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। (গ) রিংটোন হিসেবে কুরআন তিলাওয়াত ব্যবহার করলে অনেক সময় এমন হওয়া স্বাভাবিক যে, কে কল করেছে তা দেখা ও কল রিসিভ করার ব্যস্ততার দরুণ তিলাওয়াতের প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করার সুযোগ হয় না। অথচ আদব হলো, কুরআন তিলাওয়াত চলতে থাকলে কাজ বন্ধ করে মনোযোগ দিয়ে তিলাওয়াত শ্রবণ করা। (ঘ) কারো মোবাইলে রিং আসলে সে যেহেতু রিসিভের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং রিসিভ করাই তার মূল উদ্দেশ্য থাকে তাই আয়াতের যে কোনো স্থানেই তিলাওয়াত চলতে থাকে সেদিকে খেয়াল না করে রিসিভ করে ফেলে। ফলে অনেক সময় উচ্চারিত অংশের বিবেচনায় আয়াতের অর্থ বিকৃত হয়ে যায়। আর পবিত্র কুরআনের অর্থ বিকৃতি যে কত বড় গুনাহের কাজ তা বলাই বাহুল্য!
মোটকথা বহু কারণেই আজান, জিকির, তিলাওয়াত ইত্যাদিকে রিংটোন হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা জরুরি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমীন। [আল আশবাহ ওয়ান্ নাযায়ের, পৃষ্ঠা ঃ ৩৫ আল কাফী, খণ্ড ঃ ১, পৃষ্ঠা ঃ ৩৭৬ ফাতাওয়ায়ে আলমগীরি, খণ্ড ঃ ৫, পৃষ্ঠা ঃ ৩১৫ আত্ তিবইয়ান ফি আদাবি হামালাতিল কুরআন, পৃষ্ঠা ঃ ৪৬ রদ্দুল মুহতার, খণ্ড ঃ ১, পৃষ্ঠা ঃ ৫১৮] রিংটোন হিসেবে গান ও মিউজিক কখনোই ব্যবহার করবেন না ইসলামি শরিয়তে গানবাদ্য করা, শুনা নাজায়েয ও হারাম। বাজনা-মিউজিক ইত্যাদি গানের সাথে শুনা কবীরা গুনাহ। গান ছাড়া পৃথকভাবে শুনাও গুনাহ। তাই যে কোনো ধরনের গান-বাজনা, মিউজিক টোন ইত্যাদি মোবাইলের রিংটোন হিসেবে ব্যবহার করা নাজায়েয ও গুনাহের কাজ। তাছাড়া এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, মিউজিক বা গান রিংটোন হিসেবে ব্যবহার করলে নিজে শুনার গুনাহ তো আছেই, সেই সাথে যেখানে রিংটোন বেজে উঠে সেখানকার আশেপাশের লোকদেরকে গান-বাদ্য শুনানোর গুনাহও হয়। তদুপরি এমন রিংটোন মসজিদে বেজে ওঠলে মসজিদের পবিত্রতা ক্ষুন্ন হয়। অথচ অনেক ভাইকে দেখা যায়, তারা মোবাইলের রিংটোন হিসেবে গানের টোন, মিউজিক ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন। কেউ কেউ আবার মোবাইল কোম্পানি, কম্পিউটার বা অন্য মোবাইল থেকে পছন্দের গান, মিউজিক ইত্যাদি নিজের মোবাইলে ডাউনলোড করে তাকে রিংটোন হিসেবে ব্যবহার করেন।
আশ্চর্যের কথা হলো, ওদের ভাবসাব দেখে মনে হয়, এসব অন্যায় ও শরিয়ত বিরোধী কাজ করতে পেরে তারা বেশ খুশি! হায়রে মুসলমান! তোমরা যদি এই অন্যায়ের অপকারিতা ও ক্ষতি সম্পর্কে জানতে এবং তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করতে তাহলে কখনো এহেন গর্হিত কাজ করতে সাহস পেতে না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রিংটোন হিসেবে গানের টোন, মিউজিক ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে হেফাজত করুন। আমীন। [সূরা লোকমান, আয়াত ঃ ৬ বোখারি শরিফ , খণ্ড ঃ ২, পৃষ্ঠা ঃ ৮৩৭ তিরমিযি শরিফ, খণ্ড ঃ ১, পৃষ্ঠা ঃ ২৪১ সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা ঃ ৩০০ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব, খণ্ড ঃ ৪, পৃষ্ঠা ঃ ১৮৪ শামী, খণ্ড ঃ ৯, পৃষ্ঠা ঃ ৫৬৬ আল গিনা ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা ঃ ৮৭ ফতহুল কাদীর, খণ্ড ঃ ৬, পৃষ্ঠা ঃ ৪৮২]
রিংটোন হিসেবে সালামের ব্যবহার নাজায়েয নয় কারো মোবাইলে কল আসলে তা মোবাইলধারীকে অবহিত করার জন্য যে আওয়াজটি বেজে উঠে তা আমাদের সবার কাছে ‘রিংটোন’ হিসেবে পরিচিত। অনেকে স্বীয় মোবাইলে সালাম ডাউনলোড বা রেকর্ড করার পর তাকে রিংটোন হিসেবে ব্যবহার করে। এরূপ করায় শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো সমস্যা নেই। অর্থাৎ সালামকে রিংটোন হিসেবে ব্যবহার করা জায়েয। কেননা সালামের দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো, সালামকে অপরের জন্য দোয়া বা অভিবাদন হিসেবে ব্যবহার করা; আর অপরটি হলো, কারো ঘরে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনার জন্য ব্যবহার করা। মোবাইলের রিংটোনও এ দ্বিতীয় প্রকারের সাথে কিছুটা মিলে যায় বিধায় রিংটোন হিসেবে সালামের ব্যবহার নাজায়েয নয়। [মোবাইল ফোনের শরয়ি আহকাম, পৃষ্ঠা ঃ ২৯]
বাচ্চাদের কান্না থামানোর জন্য নাজায়েয রিংটোন বাজানো মারাত্মক অন্যায় অনেক মা-বোনকে দেখা যায় তারা বাচ্চাদের কান্না থামানোর জন্য মোবাইলে গানের রিংটোন বাজিয়ে থাকেন। আমার ধারণা, এর মারাত্মক পরিণতি ও গুনাহের বিষয়টি অজানা থাকার কারণেই তারা এমনটি করে থাকেন। তারা হয়তো মনে করেন, বাচ্চাদের তো শরিয়তের বিধি-নিষেধ পালন করা জরুরি নয়! অথচ তারা জানেন না যে, শরিয়তের হুকুম আহকাম বাচ্চাদের জন্য পালন করা জরুরি না হলেও বড়দের জন্য এটা জায়েয নেই যে, তারা বাচ্চাদের দ্বারা শরিয়ত বিরোধী কোনো কাজ করাবেন। যেমন, ফেকাহবিদগণ বলেছেন, বয়স্ক ব্যক্তিরা যদি ছোটদেরকে কিবলার দিকে ফিরিয়ে প্রস্রাব করায় তাহলে এর দ্বারা বাচ্চাদের কোনো গুনাহ হবে না ঠিকই, কিন্তু বয়স্করা অবশ্যই গুনাহগার হবেন। অনুরূপভাবে কোনো ছোট বাচ্চার ছবি উঠালে বাচ্চাটির কোনো গুনাহ না হলেও যিনি ছবি উঠালেন তার নিশ্চয়ই গুনাহ হবে। এমনিভাবে বাচ্চাদেরকে গানের বাজনা শুনানোর একই হুকুম। অর্থাৎ যিনি শুনাবেন তিনি গুনাহগার হবেন।
এখানে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, যে গান-বাজনায় অন্তর গাফেল হয়, হৃদয়ে মুনাফেকী সৃষ্টি হয়, মন শক্ত হয়ে যায়, আল্লাহর ভয় লোপ পায় সে গান-বাজনা কী করে আমরা আমাদের কলিজার টুকরা বাচ্চাদের কান্না থামানোর জন্য ব্যবহার করছি? আমরা কি একটি বারও খেয়াল করে দেখেছি যে, এই গান-বাদ্য শুনানোর দ্বারা কোমলমতি বাচ্চাদের অন্তরে আমরা পাপ-প্রবণতার বীজ বপন করছি? অথচ আমরা ইচ্ছা করলে কান্না থামানোর জন্য অন্য কোনো পদ্ধতি যেমন পশু-পাখির টোন, রেকর্ডকৃত হামদ-নাত ইত্যাদি শুনাতে পারি।
আসলে আমাদের মধ্যে আজ পাপ ও পাপের ভয়াবহ পরিণতির উপলব্ধি অনেকাংশে কমে গেছে। যার ফলে অনেক সময় আমাদের মধ্যে এ চিন্তাটুকুও আসে না যে, আমরা যা করছি তাতে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনো পাপ নেই তো? তাতে আল্লাহ তা‘আলা নারাজ হবেন না তো? মুসলমান হিসেবে এই কাজটি আমাদের জন্য অশোভনীয় নয় তো? ইত্যাদি। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে গুনাহের মারাত্মক পরিণতি ও কঠিন শাস্তির কথা চিন্তা করে যাবতীয় গুনাহ থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। [মোবাইল ফোনের শরয়ি আহকাম, পৃষ্ঠা ঃ ৫২]